তাহার চোখ দুটা বুনো মহিষের চোখের মতো যেন আগুন হানিতে থাকে কিন্তু তখনই যদি বিভা তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়ায়, তাহা হইলে তাহার সেই অগ্নিদৃষ্টি অমৃতে অভিষিক্ত দুটি ফুলের অঞ্জলির মতো তাহার চরণতলে লুটাইয়া পড়ে!
একদিন কাল্লু পর্দার ফাঁক দিয়া দেখিল, সেই শয়তানটা বিভার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে তুলিয়া ধরিয়া, নিজের হাত হইতে একটা আংটি খুলিয়া বিভার আঙুলে পরাইয়া দিল! তারপর সেই হাতখানিকে ধরিয়া চুম্বন করিল—তাহারই চোখের উপরে!
আজ কাল্লুর সর্বাঙ্গে একেবারে আগুন ধরিয়া উঠিল। তাহার অন্তরের পুরুষত্ব উন্মত্ত হইয়া তাহাকে লাঞ্ছিত পীড়িত বিদলিত করিতে লাগিল। তাহার পায়ের তলা দিয়া মাটি সরিয়া চলিতে লাগিল, তাহার চোখের সামনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পাগলের মতো টলিয়া টলিয়া বোঁ বোঁ করিয়া ঘুরিতে লাগিল! কোথায় তাহার আশ্রয়? কোথায় তাহার অবলম্বন?
কতক্ষণ সে এমন ছিল, সে জানে না। অকস্মাৎ দেখিল, তাহার সমুখে সেই যুবকটি দাঁড়াইয়া হাসি মুখে দুটি টাকা ধরিয়া বলিতেছে—“বেয়ারা, এই লেও বকশিশ!” কাল্লু দেখিল, সেই যুবকের ঠোঁটের উপর ও ত’ হাসি নয়, ও যেন আগুনের রেখা! তাহার হাতে ও ত’ টাকা নয়, ও যেন দুখণ্ড উল্কা! আর সেই লোকটা ত’ মানুষ নয়, সে সাক্ষাৎ শয়তান! ইহারই কথা সে মিশনারী সাহেবদের কাছে পড়িয়াছিল, আজ একেবারে তাহার সহিত চাক্ষুষ সাক্ষাৎ! তাই উহার বর্ণ অমন আগুনের মতন! তাই উহাকে দেখিলে কাল্লুর অন্তরে অমনতর অগ্নিজ্বালা জ্বলিয়া উঠে! কাল্লুর মাথায় খুন চাপিয়া গেল, তাহার চোখ দিয়া আগুন ঠিকরাইতে লাগিল, তাহার দশাঙ্গুলের নখের মধ্যে রক্ত-পিপাসা ঝঞ্চনা হানিয়া গেল! এমন সময় তাহার কানে গেল কোন স্বর্গের পরম দেবতার অমোঘ আদেশ ‘কাল্লু, বাবু বকশিশ দিচ্ছেন, নে।” কাল্লু মন্ত্রবশ সর্পের মতো মাথা নত করিয়া তাহার কম্পিত হস্ত প্রসারিত করিয়া ধরিল, যুবকটি তাহার হাতের উপর টাকা দুটি রাখিয়া দিল।
কাল্লুর মনে হইতে লাগিল, টাকা দুটা তাহার হাতের তেলো পুড়াইয়া ফুটো করিয়া অপর দিক দিয়া মাটিতে ঝনঝন করিয়া পড়িয়া যাইবো সে-ঝনকার তাহার কাছে বজ্র-বিদারণশব্দের ন্যায় মনে হইলা সে প্রাণপণে টাকা দুটাকে চাপিয়া মুঠি করিয়া ধরিল,হাত পুড়িয়া যায় যাক, কিন্তু টাকা দুটা মাটিতে পড়িয়া অট্টহাস্য না করিয়া উঠে!
যখন তাহার চৈতন্য ফিরিয়া আসিল তখন তাহার মনে হইল, এই অগ্নিখণ্ড দুটা সেই শয়তানটার মুখের উপর হুঁড়িয়া ফেলিয়া দিতে পারিলে বেশ হইতা তাড়াতাড়ি ভালো করিয়া চোখ মেলিয়া চাহিয়া সে ছুঁড়িতে গিয়া দেখিল সেখানে কেহ নাই, সে একা দরজার একপাশে আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া আছে।
কাল্লু মুশকিলে পড়িয়া গেল, এই টাকা দুটা লইয়া সে কি করিবে! এ সে লইল কেন, এ ত’ সে লইতে পারে না! কি করিবে, কি করিবে সে এই টাকা দুটা লইয়া! তাহাকে ঘিরিয়া চারিদিকে যেন টাকার মতো চাকা চাকা আগুনের চোখ জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতে লাগিল—যেন সেই লোকটার চশমাপরা চোখ দুটার হাসিভরা ক্রুর দৃষ্টি!
কাল্লু টাকা দুটাকে মুঠায় চাপিয়া ধরিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল! সে কোথায় ফেলিবে এই বিষের চাকতি দুটা। যেখানে পড়িবে সেখানকার সকল সুখ সকল আনন্দ সকল শুভ সকল হাসি জ্বলিয়া পুড়িয়া খাক হইয়া যাইবে।
তাহাকে টাকা হাতে করিয়া ভাবিতে দেখিয়া একজন ভিখারী তাহাকে বলিল—“এক পয়সা ভিখ মিলে বাবা।” কাল্লু হঠাৎ যেন অব্যাহতি পাইয়া বাঁচিয়া গেল সে তাড়াতাড়ি দুটা টাকাই সেই পঙ্গুর হাতে দিয়া ফেলিল। অনন্ত উড়ে তাহা দেখিয়া হাসিয়া বলিল—“কি রে কালু, তু কল্পতরু হউচি পরা!” স্কুলময় রটিয়া গেল কাল্লুর মনিবের বিবাহ হইবে বলিয়া কাল্লু মনের আনন্দে একটা ভিখারীকে দু-দুটা টাকা দান করিয়া বসিয়াছে!
৫
আজ বিভার বিবাহ। সেখানে কত লোকের নিমন্ত্রণ হইয়াছে, কাল্লুর হয় নাই। তবু তাহাকে সেখানে যাইতে হইবে। স্কুলের বোর্ডিঙের মেয়েদের নিমন্ত্রণ হইয়াছে তাহাদের গাড়ীর সঙ্গে তাহাকে বিনা নিমন্ত্রণেও যাইতে হইবো আজ তাহার সম্পূর্ণ পরাজয়ের দিন। সেখানে আজ আলোক-সমারোহের মধ্যে সুসজ্জিত হইয়া হাসিমুখে সেই শয়তান ডাকাতটা চিরজন্মের মতো তাহার পিয়ারী গোরী-বাবাকে আত্মসাৎ করিত আসিবে, সেখানে আজ তাহাকে সহিসের নীল রঙের কুৎসিত উর্দি পরিয়া ম্লান মুখে বিনা আহ্বানে যাইতে হইবে, কিন্তু তাহার ভিতরে প্রবেশের অধিকার থাকিবে না, তাহাকে দ্বারের বাহিরেই দাঁড়াইয়া থাকিতে হইবে।
তাহাকে যাইতেই হইল। তাহার চোখের সামনে সেই শয়তানটা নিজের হাতে বিভার হাত ধরিয়া ফুলের মালায় বাঁধিয়া তাহাকে চিরদিনের জন্য দখল করিয়া লইল। তখন কাল্লু পুষ্পবিভূষণা আলোকসমুজ্জ্বলা সভা হইতে পলায়ন করিয়া আপনার অন্ধকার দুর্গন্ধ আস্তাবলে আসিয়া বিচালির বিছানায় শুইয়া বিভার-দেওয়া বইখানি বুকে চাপিয়া পড়িয়া রহিল।
সেই দিন হইতে স্কুল তাহার কাছে শূন্যাকার অন্ধকার। শতেক বালিকা যুবতীর হাসি সৌন্দর্য আনন্দলীলা সত্বেও একজনের অভাবে সেস্থান নিরানন্দ অসুন্দর! সে গাড়ীর পিছনে চড়িয়া বিভাদের বাড়ীতে যায়, কিন্তু সেখান হইতে বিভা আর স্মিতমুখে বাহির হইয়া আসিয়া তাহার হাতে বই দেয় না গাড়ীর জানলাটির কাছে বিভার সোনার কমলের মতন অপরূপ সুন্দর মুখোনি আর হাসিতে ঝলমল করে না। সে বাড়ী হইতে বাহির হয় কাল্লুর চক্ষুশূল সেই ভিমরুলটা, আর সে-ই গাড়ীর মুখের কাছে বসিয়া বসিয়া তাহাকে দেখিয়া দেখিয়া হাসে!