৪
এমনি করিয়া দিনের পর দিন গাঁথিয়া বছরের পর কত বছর চলিয়া গেল। কত মেয়ে স্কুলে নূতন আসিল, কত মেয়ে স্কুল হইতে চলিয়া গেল। কাল্লুর চোখের সামনে তিল তিল করিয়া কিশোরী বিভা যৌবনের পরিপূর্ণতায় অপরূপ সুন্দরী হইয়া উঠিলা কেবল কোনো পরিবর্তন হইল না কাল্লুর মনের এবং অদৃষ্টের। কিন্তু তাহার কর্মের পরিবর্তন হইয়াছে। বিভা এম. এ. পাশ করিয়া স্কুলে পড়াইতেছে কাল্লু লেখাপড়া জানে বলিয়া বিভা তাহাকে দুপ্রহরের জন্য বেহারা করিয়া লইয়াছে। সকাল-বিকাল সে সহিসের কাজ করিয়া দুপ্রহরে গোরী-বাবার বেহারার কামও করো ইহাতে তাহার পাওনা বেশী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাহার বেশেরও পরিবর্তন ও পরিপাট্য হইয়াছে। এখন সে অন্তত দুপুরবেলাটা চুড়িদার পায়জামার উপর ধোয়া চাপকান পরিতে পায় মাথার চুলগুলিকে সেই কাঠের কাঁকইখানি দিয়া আঁচড়াইয়া তাহার উপর শাদা কাপড়ের পাগড়ী বাঁধে আর গোরী-বাবার আপিসঘরের দরজায় সে পাষাণমূর্তির মতো নিশ্চল হইয়া হুকুমের প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়া থাকে। এখন সে অনেকক্ষণ ধরিয়া পিয়ারীকে দেখিতে পায়। তাহার দিল এখন পুরা ভরপুর আছে!
এই সময় একজন বাবু বড় ঘনঘন কাল্লুর গোরী-বাবার কামরায় আনাগোনা করিতে আরম্ভ করিল। তাহার সহিত বিভার বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছিল। তাহার গায়ের রং এমন সুন্দর যে সোনার চশমা যে তাহার নাকে আছে, তাহা বুঝিতে পারা যায় না সুন্দর সুগঠিত শরীর, দেখিবার মতো তাহার মুখোনি। কিন্তু ইহাকে কাল্লু মোটেই দেখিতে পারিত না। ইহাকে দেখিলেই কাল্লুর মাথায় খুন চড়িত, তাহার চোখ দুটা কয়লার মালসায় দুখানা জ্বলন্ত আঙারের মতন জ্বলিয়া উঠিত।
প্রথম যেদিন এই সুন্দর যুবকটি আসিয়া হাসিহাসি মুখে পরদাটানা দরজার কাছে দাঁড়াইয়া নিশ্চল নিস্পন্দ কাল্লুর হাতে একখানা কার্ড দিয়া বলিল—“মেমসাহেবকো-সেলাম দেও”, তখনই তাহার হাসিবার ভঙ্গিটা কাল্লুর চোখে কেমন কেমন ঠেকিলা সে কার্ড লইয়া সন্তর্পণে পর্দা সরাইয়া বিভার হাতে গিয়া কাৰ্ডখানি দিল। কার্ড পাইয়া বিভা যেমনতর হাসিমুখেই উৎফুল্ল হইয়া চেয়ার হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল—“বাবুকো সেলাম দেও।”—বিভার তেমনতর উৎফুল্ল আনন্দমূর্তি কখনো কাল্লুর দেখিবার সৌভাগ্য হয় নাই। তাই গোরী-বাবার এইরূপ আনন্দের আতিশয্য কাল্লুর মনে কেমন একটা অশুভ-আশঙ্কা জাগাইয়া তুলিল। তারপর যখন সে পর্দাটা একপাশে সরাইয়া ধরিয়া যুবকটিকে বলিল—“যাইয়ো” এবং পরদার ঈষৎ ফাঁক দিয়া কাল্লু দেখিতে পাইল, যুবকটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতেই বিভা হনহন করিয়া আগাইয়া আসিল, ও যুবকটি দুইহাতে বিভার দুইহাত চাপিয়া ধরিয়া মুগ্ধ নয়নে বিভার দিকে চাহিয়া রহিল, এবং বিভারও চোখ দুটি আবেশময় বিহ্বলতায় ও সুখের লজ্জায় ধীরে ধীরে নত হইয়া পড়িল, তখন কাল্লুর অন্তরাত্মা অনুভব করিল সেই আগন্তুক যুবক—ডাকু হ্যায়!—সে কাল্লুর সর্বস্ব অপহরণ করিয়া লইতে আসিয়াছে। সেইদিন হইতে তাহার মন যুবকটির প্রতি হিংসায় ও ঘৃণায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল, এবং দিনের পর দিন যত সে বিভার কাছে আনাগোনা করিতে লাগিল, ততই কাল্লুর নিষ্ফল ক্রোধ তাহার অন্তরে আগুন লাগাইয়া তাহার চোখদুটাকে জ্বলন্ত করিয়া তুলিতে লাগিল। যুবকটিকে দেখিলেই তাহার বুকের মধ্যে যখন ধকধক করিয়া উঠিত, তখন মনে হইত সে তাহার ঘাড়ের উপর লাফাইয়া পড়িয়া হাতের দশ আঙুলের নখে করিয়া তাহার বুকটাকে ছিড়িয়া ফাড়িয়া রক্ত খাইতে পারিলে তবে শান্ত হয়। সে শক্ত আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া আপনাকে সম্বরণ করিয়া রাখিত, কিন্তু সে এমন করিয়া চাহিত যে, তাহার অন্তরের সকল জ্বালা যেন দৃষ্টির মধ্য দিয়া ছুটিয়া গিয়া সেই ডাকুটাকে দগ্ধ ভস্ম করিয়া ফেলিতে পারে। আজ সে কত বৎসর ধরিয়া কৃপণের ধনের মতন যে বিভাকে হৃদয়ের সমস্ত আগ্রহ দিয়া ঘিরিয়া আগলাইয়া রাখিয়াছে, সেই। তাহার পলে পলে সঞ্চিত সর্বসুখ এই কোথাকার কে একজন হঠাৎ আসিয়া লুণ্ঠন করিয়া লইয়া যাইবে, শুধু একখানা গোরা চেহারা ও এক জোড়া সুনেহরী চশমার জোরে! কাল্লু কালো কুৎসিত মুচি, কিন্তু তাহার অন্তরে পিয়ারীর প্রতি যে একটি ভক্তি পুঞ্জিত পুষ্পিত হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার কিছু কি ঐ বাবুটার অন্তরে আছে? যদি থাকিত, তবে কি সে বিভার সম্মুখে অমন করিয়া বকবক করিয়া বকিতে পারিত, অমন হো-হো করিয়া হাসিতে পারিত, অমন করিয়া পা ছড়াইয়া চেয়ারে হেলিয়া পড়িতে পারিত! লোকটার মনে এতটুকু সম্ভ্রম নাই, এতটুকু দ্বিধা ভয় আশঙ্কা নাই! সে যেন ডাকাত, জোর করিয়া লুটপাট করিয়া লইয়া যাইতে আসিয়াছে।
কাল্লু শুনিয়াছিল যে, কয়লার মধ্যে হীরা হয়। সে যদি কয়লার মতো কালো, তাহার বুকের মধ্যে হীরার মতো উজ্জ্বল বিভাকে লুকাইয়া রাখিতে পারিত! যদি সে কালো মেঘ হইয়া বিদ্যুতের মতো এই তরুণীটিকে বুকের মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়া এই ডাকাত লোকটার মাথায় বজ্রের মতো গর্জন করিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িয়া এক নিমেষে তাহাকে জ্বালাইয়া, পুড়াইয়া খাক করিয়া ফেলিতে পারিত! কিন্তু যতই সে কোন উপায় খুঁজিয়া পাইতেছিল না, যতই সে নিজের যে কি দাবী তাহা নিজের কাছেই সাব্যস্ত করিতে পারিতেছিল না, যতই সে নিজেকে অসহায় মনে করিতেছিল, ততই তাহার অন্তর জ্বলিয়া চোখ দুটাতেও আগুন ধরাইয়া তুলিতেছিল। যুবকটিকে দেখিলেই