এমন কি বিভার সামনে দাঁড়াইতেও তাহার লজ্জা বোধ হইতে লাগিল। সে যেন অপবিত্র অশুচি, দেবতার মন্দিরে প্রবেশ করিতে ভয়ে সঙ্কোচে কুণ্ঠিত হইয়া উঠো আপনার দেহ মন শিক্ষা সহবৎ জন্ম কর্ম কিছুই তাহার বিভার উপযুক্ত তো নহে।
তবুও সে অন্তরের যৌবন-পুরুষের তাড়নায় আপনাকে যথাসাধ্য সংস্কৃত সুদর্শন করিতে চাহিল। সে রাস্তার ধারে একখানি হঁট পাতিয়া বসিয়া দেশওয়ালী হাজামের কাছে হাজামত করাইল কপালের উপরকার চুল খাটো করিয়া ছাঁটিয়া মধ্যে অর্ধচন্দ্রাকার ও দুই পাশে দুই কোণ করিয়া থর কাটিল। তারপর বাজার হইতে একখানি টিন-বাঁধানো আয়না ও একখানি কাঠের কাঁকই কিনিয়া দীর্ঘ বাবরি চুলগুলিকে প্রচুর কড়ুয়া তেলে অভিষিক্ত করিয়া শিশু-গাছের তলায়। পা ছড়াইয়া বসিয়া ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় কাঁধের উপর কুঞ্চিত সুবিন্যস্ত ফণাকৃতি করিয়া তুলিল। সেদিন সে নাহিয়া-ধুইয়া মাজিয়া-ঘষিয়া আপনাকে চকচকে সাফ করিয়া যথাসাধ্য নিজের মনের। মতন করিয়া তুলিলা কিন্তু তাহার সহিসের পোশাকটা তাহার মোটেই রুচি-রোচন হইতেছিল না। নীল রং করা মোটা ধুতির উপর হলদে-পটি লাগানো নীল রঙের খাটো কুর্তা ও নীল পাগড়ী তাহাকে যে নিতান্ত কুৎসিত করিয়া তুলিবে, ইহাতে সে অত্যন্ত অস্বস্তি ও লজ্জা অনুভব করিতে লাগিল। কিন্তু উপায় নাই, সেই কুৎসিত উর্দি পরিয়াই তাহাকে বিভার সম্মুখে বাহির হইতে হইবো তখন সেই পোশাকই অগত্যা যথাসম্ভব শোভন-সুন্দর করিয়া পরিয়া সেদিন সে গাড়ীর পিছনে চড়িয়া বিভাকে বাড়ী হইতে স্কুলে আনিতে গেল।
কিন্তু তাহাতেও তাহার অব্যাহতি নাই। তাহার চক্ষুশূল সেই ভিমরুল ছুঁড়ি তাহাকে দেখিয়াই আবার হাসিয়া গড়াইয়া বলিয়া উঠিল—“বা রে! আবার ফ্যাশন করে চুল কাটা হয়েছে!”
তাহার সেই বিশৃঙ্খল রুক্ষ চুলই মেয়ের চোখে ক্রমশ অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল আজ তাহাকে নব বেশে দেখিয়া তাহাদের আবার ভারি হাসি আসিলা বিভা ঈষৎ হাসিমুখে তাহার দিকে চাহিয়া যখন চক্ষু ফিরাইয়া ভিমরুলকে বলিল—“কি হাসিস!” তখন কাল্লুর চোখ দুটি আগুনের ফুলকির মতন ভিমরুলের দিকে চাহিয়া জ্বলিতেছিল। ভিমরুল হাততালি দিয়া হাসিয়া বলিয়া উঠিল —“দেখ দেখ বিভা-দি, ও কেমন করে তাকাচ্ছে!” বিভা যেই তাহার দিকে স্মিত মুখে তাকাইল, অমনি তাহার দৃষ্টি কোমল প্রসন্ন হইয়া যেন বিভার চরণে আপনার জীবনের কৃতার্থতা নিবেদন করিয়া দিল। বিভা ভিমরুলকে ধমক দিয়া বলিল—“কৈ কি করে তাকাচ্ছে আবার!” ভিমরুল বলিয়া উঠিল—“না বিভা-দি, ও এমনি করে কটমট করে তাকাচ্ছিল, তুমি ফিরে চাইতেই অমনি ভালো-মানুষটি হয়ে দাঁড়াল!”
ক্রমে তাহার নূতন বেশও মেয়েদের চোখে সহিয়া গেল। একজন তরুণ পুরুষ যে নিত্য তাহাদের সেবা করিতেছে, এ বোধ তাহাদের মনে জাগ্রত রহিল না। কিন্তু সেই তরুণ সহিসের মনে তরুণী একটি নারীর ছাপ দিনের পর দিন গভীর ভাবে মুদ্রিত হইয়া উঠিতেছিল।
তাহার মনে হইত, সে একদিন বিভার চরণতলের ধূলায় পড়িয়া যদি বলিতে পারে যে, সে একেবারে সাধারণ নয়, নিতান্ত অপদার্থ নয়, সেও তাহাদেরই মতো স্কুলে ইংরেজি পড়িয়াছে, এখনো দুচারটা ইংরেজি বাত সে পড়িতে পারে, সে রামায়ণ পড়িতে পারে, কাহানিয়া পড়িতে পারে!—তবে তাহার জীবন সার্থক হইয়া যায় কিন্তু পারিত না—সে কোনো দিন বিভাকে একলা পাইত না বলিয়া পারিত না, সে ভিমরুলের হাসির হুলের ভয়ে! তখন সে ভাবিত, মুখের কথা যাহাকে খুশি শুনানো যায়, আর মনের কথা মনের মানুষটিকেও শুনানো যায় না কেন? মনের মন্দিরে সে যে-সব পবিত্র অর্ঘ্য সাজাইয়া সাজাইয়া তাহার আরাধ্য দেবতার আরতির আয়োজন করিতেছিল, তাহা যদি তাহার দেবতা অন্তর্যামী হইয়া অনুভব করিতে পারিত! দেবতা যদি অন্তরের মুখের ভাষা না বুঝে, তবে মূক মুখের ভাষায় সে তো কিছুই বুঝিতে পারিবে না!
তবু একদিন সাহসে বুক বাঁধিয়া সে বিভার হাত হইতে বই লইতে লইতে উপরকার বইখানির নাম যেন নিজের মনেই পড়িল—লিগেন্ডস অফ গ্রীস অ্যান্ড রোম!
ভিমরুল অমনি হাততালি দিয়া হাসিয়া বলিল—“বিভাদি তোমার সহিস আবার ইংরিজি পড়তে পারে! এইবার থেকে তুমি ওর কাছে পড়া বলে নিয়ো!” ভিমরুলের চেয়ে বড় একটি মেয়ে সরযু হাসির বিদ্রুপের স্বরে বলিল—“লিগেন্ডস! লিগেন্ডস অফ গ্রীস অ্যান্ড রোম! লেজেন্ডসকে লিগেন্ডস বলছে!” বিভা হাসি-মুখে কাল্লুর দিকে চাহিয়া বলিল—“তুই ইংরিজি পড়তে পারিস?” কাল্লুর মনের সমস্ত বিদ্রুপ-গ্লানি লজ্জা-সঙ্কোচ বিভার হাসিমুখের একটি কথায়। কাটিয়া গেল। সে উৎফুল্ল হইয়া বলিল—“হাঁ বাবা, হাম তো কয়ইক বরষ ইংলিশ পঢ়া থা” বিভা তাহার কথা শুনিয়া হাসিল। কাল্লু সাহস পাইয়া বলিল যে, সে গোরী-বাবার পড়িয়া-চুকা পুরাণা ধুরাণা একখানা কেতাব পাইলে এখনো পড়ে। বিভা হাসিয়া বই দিতে স্বীকার করিল। গর্বের আনন্দে কাল্লুর মন ফুলিয়া উঠিল। আজ সে বিভার কাছে আপনার অসাধারণত্ব প্রমাণ করিয়া দিয়াছে! বিভা আজ তাহার সহিত কথা বলিয়াছে! বিভার প্রথম দান আজ সে পাইবে! ভিমরুল যে তাহাকে ‘পণ্ডিত সহিস’ বলিয়া ঠাট্টা করিয়া কত হাসিল, আজ আর সেদিকে সে কানই দিল না।