এইরূপে লেখাপড়া শিখিয়া ও প্রণয়রসমধুর বিচিত্র ঘটনাপূর্ণ কেতাব পড়িয়া কাল্লুর কিশোর চিত্ত পৃথিবীর সহিত পরিচিত হইবার জন্য উন্মুখ হইয়া উঠিয়াছিল। সে আর তাহার গাঁয়ে গাঁওয়ার লোকদের মধ্যে থাকিয়া তৃপ্তি পাইতেছিল না। সে স্থির করিল একবার কলকাত্তা যাইতে হইবে সেখানে তাহার চাচেরা ভাই বহুত টাকা কামাই করে।
কাল্লুকে বাধা দিবার কেহ ছিল না সে জগৎসংসারে একা। আপনার বাপের হাতিয়ারগুলি থলিতে ভরিয়া সে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইল।
তাহার ভাই বলিল যে, রাস্তায় রাস্তায় রোদে বৃষ্টিতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া জুতা সেলাই করিয়া। বেড়াইতে তাহার বড় তকলিফ হইবে তাহার চেয়ে কাল্লু স্কুলে নোকরি করুক। স্কুলে একটি নোকরি খালি আছে।
স্কুলে নোকরি! শুনিয়া কাল্লু উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। চাই কি সে সেখানে নিজের বিদ্যাচর্চারও সুবিধা করিয়া লইতে পারো তাহার পর যখন শুনিল যে, সেটা জানানা স্কুল, তখন তাহার কল্পনাপ্রবণ মন সেখানকার পদমাবতী শাহরজাদী ও পরীবানুদের স্বপ্নে ভরপুর হইয়া উঠিল।
কিন্তু পরীবানুদের সহিত প্রথম দিনের পরিচয়ের সূত্রপাত তাহার তেমন উৎসাহজনক মনে হইল না। পরীর মতো বেশভূষায় মণ্ডিত ফুলের মতো মেয়েগুলি যেন হাসির দেশের লোক!
কাল্লু ঘোড়ার সাজ খুলিয়া দানা দিয়া উদাস মনে আসিয়া আস্তাবলের সামনে একটা শিশুগাছের ছায়ায় গামছা পাতিয়া পা ছড়াইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল। মেয়েগুলো তাহাকে দেখিয়া অমন করিয়া মিছামিছি হাসিয়া খুন হইল কেন? তাহার চেহারার মধ্যে সি পাইবার মতো এমন কি আছে? তাহার গাঁয়ের বাচ্চী আকালী পবনী তো তাহাকে দেখিয়া কৈ এমন করিয়া হাসে না! কিসমতিয়া ইদারা হইতে জল ভরিয়া হাত দুলাইতে দুলাইতে বাড়ী ফিরিবার সময় তাহার গায়ে জল ছিটাইয়া দিয়া হাসিত বটে, কিন্তু তাহার হাসি তো এমন খারাপ লাগিত না— তাহার সেই দিললগীতে তো দিল প্রসন্নই হইয়া উঠিত! যত নষ্টের গোড়া ঐ কোঁকড়া-চুলওয়ালী ছোঁড়ী। ভিমরুলের উপর তাহার ভারি রাগ হইতে লাগিল—সেইই তো প্রথমে হাসি আরম্ভ করিয়া দিয়াছিল। সব মেয়েগুলোই খারাপ কেবল—কেবল—ঐ গোরীবাবা ভারি ভালো! সে
তাহাকে দেখিয়া হাসে নাই, সকলকে হাসিতে মানা করিয়াছে, ভিমরুলকে মারিতে পর্যন্ত চাহিয়াছিল! ঐ বাবা বহুত নিক। বহুৎ খুবসুরৎ।
কাল্লু বসিয়া বসিয়া যত ভাবে ততই তাহার বিভাকে বড়ই ভালো লাগে সে তাহার দৃষ্টিতে কেমন করুণা ভরিয়া একবার উহার দিকে তাকাইয়াছিল! সে কেমন করিয়া উহাকে সকলের হাসির আঘাত হইতে আড়াল করিয়া রাখিতেছিল! বহুত নিক! বহুত খুবসুরৎ! সেই গোরীবাবা!
৩।
এইরূপে সে দিনের পর দিন ধরিয়া কত মেয়েকে দেখিতে পায়, কত মেয়ের হাত হইতে সে বই গ্রহণ করে। কিন্তু কোনো মেয়েই তাহার প্রাণের উপর তেমন আনন্দের ছটা বিস্তার করে না, যেমন হয় তাহার বিভাকে দেখিলো। আর সকলের কাছে সে ভৃত্য, গাড়ীর সহিস, সে অস্পৃশ্য মুচির ছেলে কুণ্ঠিত সঙ্কুচিত অপরাধীর মতন কিন্তু বিভাকে দেখিলেই তাহার অন্তরের পুরুষটি তারুণ্যের পুলকে জাগিয়া উঠে, মনের মধ্যে আনন্দের রসের শিহরণ হানে, তাহার দৃষ্টিতে কৃতার্থতা ঝরিয়া ঝরিয়া বিভার চরণকমলের জুতার ধূলায় লুণ্ঠিত হইতে থাকে। বসন্তের অলক্ষিত আগমনে তরুশরীরে যেমন করিয়া শিহরণ জাগে, যেমন করিয়া নব-কিশলয়দলে শুষ্ক তরুর অন্তরের তরুণতা বিকশিত হইয়া পড়ে, যেমন করিয়া ফুলে ফুলে তাহার প্রাণের উল্লাস উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, মধুতে গন্ধে যেমন করিয়া ফুলের প্রাণে রসসঞ্চার হয়, বিভাকে দেখিয়া কিশোর কাল্লুর অন্তরের মধ্যেও তেমনি একটি অবুঝ যৌবনের বিপুল সাড়া পড়িয়া গেল, তাহার অন্তরের পুরুষটি প্রকাশ পাইবার জন্য মনের মধ্যে আকুলি-ব্যাকুলি করিতে লাগিল। তাহার শিক্ষা ও অশিক্ষার মধ্যবর্তী অপটু অক্ষম মন চাহিতেছিল, সেও তেমনি করিয়া আপনার অন্তরবেদনা তাহার আরাধিতার চরণে নিবেদন করে, যেমন করিয়া বজ্রমুকুট পদমাবতীকে তাহার হৃদয়বেদনা নিবেদন করিয়াছিল যেমন করিয়া শাহজাদা পরীজাদীকে তাহার মর্তমানবের মনের ব্যথা বুঝাইতে পারিয়াছিল। তাহার মনের কোণের গুঢ় গোপন প্রণয়বেদনা সে কেমন করিয়া এই অনুপমা মহীয়সী রমণীর চরণে নিবেদন করিবে! সে যদি তাহাদের গ্রামের কিসমতিয়া হইত, তাহা হইলে কোনো কথা ছিল না কিন্তু ইহার তো কিসমতিয়ার সহিত কোনোই মিল নাই! এ না পরে ঢিলি চুনুরি, লাহেঙ্গা, না পরে আঁটি আঙিয়া না যায় ইঁদারায় জল আনিতে, না সে কাজরী গীত গাহিয়া তাহাকে সাহসী করিয়া তোলে! এ যে এ জগতের জীব নয়! এর পরণের শাড়ীখানি বিচিত্র মনোরম ভঙ্গিতে তাহার কিশোর সুকুমার তনু দেহখানির উপর সৌন্দর্যের স্বপ্নের মতন অনুলিপ্ত হইয়া আছে ইহার গায়ের ঝালর-দেওয়া ফুলের জালি-বসানো জামাগুলির ভঙ্গি যেন কোন স্বর্গলোকের আভাস দেয়। ইহার পায়ে জুতা, চোখে সুনেহরী চশমা। ইহার কাছে সে কত হীন, কত অপদার্থ, কি সামান্য! সে আপনার মনের ভাবলীলার বিচিত্র মাধুর্যের কাছে নিজের ক্ষুদ্রতায় নিজেই কুণ্ঠিত লজ্জিত সঙ্কুচিত হইয়া পড়িতেছিল, সে পরের কাছে তাহার মনের কথা প্রকাশ করিবার কল্পনাও করিতে পারে না।