- বইয়ের নামঃ বায়ু বহে পূরবৈয়াঁ
- লেখকের নামঃ চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই
বায়ু বহে পূরবৈয়াঁ
মেয়ে-স্কুলের গাড়ির সহিস আসিয়া হাঁকিল—“গাড়ি আয়া বাবা।”
অমনি কালো গোরো মেটে শ্যামল কতকগুলি ছোট বড় মাঝারি মেয়ে এক-এক মুখ হাসি আর চোখভরা কৌতুক-চঞ্চলতা লইয়া বই হাতে করিয়া আসিয়া দরজার সমুখে উপস্থিত হইল একটি ছোট মেয়ে একমাথা কোঁকড়া-কোঁকড়া ঝাঁকড়া চুল ময়ূরের পেখম-শিহরণের মতন কাঁপাইয়া তুলিল। হাসিয়া হাসিয়া গড়াইয়া পড়িতে পড়িতে, তাহার পশ্চাতে দণ্ডায়মান একটি কিশোরী সুন্দরীকে বলিল—“দেখ ভাই বিভাদি, এ আবার কি রকম সহিস!”
বিভা তাহার সুন্দর চোখ দুটি নূতন সহিসের মুখের উপর একবার বুলাইয়া লইয়া হাসিমুখে বলিল—“কি রকম সহিস আবার? অত হাসছিস কেন মিছি-মিছি?”
ছোট মেয়েটি তেমনি হাসিতে হাসিতে বলিল—“কত বড় ঘোড়ার কতটুকু সহিস!”
এতক্ষণে তাহার হাসির কারণ বুঝিতে পারিয়া সব মেয়ে ক’টিই হাসিয়া হাসিয়া বার বার তাহাদের স্কুলগাড়ীর ছোট্ট নূতন সহিসের দিকে চাহিতে লাগিল।
সহিস বেচারা একেবারে নূতন, তাহাতে বালক এই সব ফুলের মতো মেয়েদের পরীর মতো বেশ দেখিয়াই সে অবাক হইয়া গিয়াছিল। এখন তাহাদের হীরক-ঝরা হাসির ধারা দেখিয়া একেবারে অভিভূত হইয়া পড়িল। সঙ্কোচে লজ্জায় থতমত খাইয়া সে একবার ঈষৎ চোখ তুলিয়া অপাঙ্গে মেয়েদের দিকে তাকায়, আবার পরক্ষণেই চক্ষু নত করে।
বিভার মনে পড়িল রবিবাবুর ইওরোপের ডায়ারির কথা। ইটালিতে আঙুরের মতো একটি ছোট্ট মেয়ে প্রকাণ্ড একটা মোষকে দড়ি ধরিয়া চরাইয়া লইয়া বেড়াইতেছে দেখিয়া, চশমাপরা দাড়িওয়ালা গ্রাজুয়েট স্বামীর ছোট্ট নোলক-পরা বৌয়ের উপমা তাঁহার মনে পড়িয়াছিল। বিভারও তাই ভারি হাসি পাইল। সে হাসিমুখে তাহার সঙ্গিনীদের ধমকাইয়া বলিল—“নে নে থাম, শুধু শুধু হাসতে হবে না। চ।
পশ্চাৎ হইতে পুরাতন সহিস চিৎকার করিয়া উঠিল—“আস না বাবা! বহুত দেরি হচ্ছে যে!”
মেয়েগুলি কাহারো শাসন না মানিয়া তেমনি হাসিতে হাসিতে লজ্জিত কুণ্ঠিত বালক সহিসের হাতে নিজেদের বই শেলেট খাতা চাপাইয়া দিয়া চলন্ত ফুলগুলির মতো আপনাদের চারিদিকে একটি রূপের মোহের আনন্দের হিল্লোল বহাইয়া একে একে গিয়া গাড়ীতে উঠিল—কোনোটি ফুটন্তু, কোনোটি ফোটো ফোটো, কোনোটি বা মুকুল কলিকা। সহিস দুজন গাড়ির পিছনে পা দানের উপর চড়িয়া দাঁড়াইল। গাড়ি দূরের মেঘ-গর্জনের মতো গুরু-গম্ভীর শব্দে পাড়াটিকে উচ্চকিত করিয়া অপর পাড়ায় মেয়ে কুড়াইতে ছুটিয়া চলিতে লাগিল।
যে মেয়েটি প্রথমেই হাসির ফোয়ারার চাবি খুলিয়া দিয়াছিল, সে লম্বা গাড়ীর অন্ধকার জঠরের ভিতর হইতে গাড়ীর পিছন দিকের চৌকা জানালার ঘুলঘুলির মুখের কাছে সেই নৃতন সহিসকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া আবার হাসিতে হাসিতে কুটিকুটি হইয়া বলিল—“দেখ বিভাদি দেখ, ওর মাথায় কি টোকা-পানা-চুল!”
বিভা গাড়ীর পিছনের জানলার মুখের কাছেই বসিয়া ছিল। সে একবার যেন বাহিরের দিকে চাহিতেছে, এমনি ছলে নূতন সহিসকে দেখিয়া লইল। তাহার একমাথা বাবরি চুল রুক্ষ জটায়। এলোমেলো হইয়া মুখের চারিদিকে উড়িয়া উড়িয়া আসিয়া পড়িতেছে। তাহার মাঝখানে যেন কালো পাথর কাটিয়া কুঁদিয়া-বাহির-করা কিশোর সুকুমার মুখোনি একটি নীল পদ্মের মতো, রমণীয় হাসির সম্মুখে লজ্জিত কুণ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছে।
বিভা সংক্রামক হাসি কষ্টে চাপিয়া চোখ দুটিতে তিরস্কার হানিয়া হাসির রাণী সেই মেয়েটিকে বলিল—“দেখ ভিমরুল, ফের হাসলে মার খাবি।”
এ শাসনে কেহই বশ মানিল না। এক-এক বাড়ী হইতে এক-একটি নূতন মেয়ে আসিয়া গাড়ীতে চড়ে, আর হাসির ছোঁয়াচ লাগিয়া হাসির প্রবাহ আর থামিতে দেয় না। গাড়ীর ভিতরে ভিড়ও যত বাড়ে ঠাসাঠাসির মধ্যে হাসিও তত জমাট হইয়া উঠো
কিশোর সহিসটি সেই ঘুলঘুলির মুখের কাছে ঠায় দাঁড়াইয়া নিরাশ্রয় অসহায় ভাবে কিশোরীদের হাসির সূচিতে বিদ্ধ হইতে লাগিল। সে আপনাকে লুকাইতে চাহিতেছিল, কিন্তু তাহার লুকাইবার জো ছিল না। তখন সে যথাসম্ভব এক পাশে সরিয়া দাঁড়াইয়া বিভার আড়ালে আপনাকে গোপন করিল। সে ছাতুখোর মেড়ো এবং একেবারে গাঁওয়ার হইলেও এটুকু সে বুঝিতেছিল যে, যে-মেয়েটি জানলার মুখের কাছে বসিয়া আছে, সে মেয়েটি তাহাকে দেখিয়া না হাসিতেই চাহিতেছে সে সকলের হাসির হাত হইতে তাহাকে বাঁচাইতে পারিলে বাঁচাইতা সে একবার করুণ নেত্রে বিভার দিকে ক্ষণিকের জন্য তাকাইয়া কুণ্ঠিত নতনেত্রে দাঁড়াইয়া রহিল।
মেয়েস্কুলের বিশ্বম্বহ দীর্ঘ গাড়ী পথ কাঁপাইয়া, পথিকদের ব্যগ্র সচকিত করিয়া, হাজার দৃষ্টির উপর অতৃপ্তির ঝিলিক হানিয়া, বিরাট অবহেলার মতন, একবুক আনন্দ-প্রতিমা বহিয়া স্কুলে গিয়া পৌঁছিল। কিশোর সহিস অব্যাহতি পাইয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল।
২
সে মুচির ছেলে। তাহার নাম কাল্লু।
ছেলে হাকিমের দপ্তরে নোকরি পাইবে, এই আশায় তাহার বাপ তাহাকে ইংরেজি স্কুলে পড়িতে দিয়াছিল। প্রথমে যে-স্কুলে সে ভর্তি হইতে গেল, সেখানে সে মুচির ছেলে বলিয়া স্কুলের কর্তারা হইতে ছাত্রেরা পর্যন্ত আপত্তি তুলিয়াছিল। শেষে আরা শহরে এক সাহেব মিশনারির স্কুলে স্থান পাইয়া সে বছর ছয়েক ইংরেজি ও নাগরী শিক্ষা করিয়াছিল। তারপর তাহার পিতার মৃত্যু হইলে গ্রামের মাতব্বরেরা বলিল, কাল্লুর লিখা-পড়ি শিখিয়া কোনো ফায়দা নাই তাহার বাপদাদার পেশা অবলম্বন করাই উচিত। তখন বেচারা বইয়ের দপ্তর ফেলিয়া জুতাসেলাইয়ের থলি ঘাড়ে করিলা তাহার হাকিমের দপ্তরে নোকরি করিয়া মাতব্বর হওয়ার কল্পনা বাপের মৃত্যুর সঙ্গেই মিলাইয়া গেল। তবু তাহার জাতভাই-বিরাদরীর মধ্যে কাল্লুর খাতির হইল যথেষ্ট—সে তুলসীকৃত রামায়ণ পড়িতে পারে সে বিরাদরীর পঞ্চায়েৎ মজলিশে তোতাকাহিনী, বেতাল-পঁচিশী, চাহার দরবেশ পড়িয়া শুনাইতে পারে খত চিঠঠি বাচাইতে পারে এবং সাড়ে সাত রূপেয়া তনখা হইলে এক রোজের মজদুরী কত, বা শতকরা দশ রূপেয়া সুদ হইলে, এক রূপেয়ার সুদ কত মুখে মুখে কষিয়া দিতে পারে।