মহাত্মার প্রথম অসহযোগ-আন্দোলনে বাংলার চাষি, যাদের অধিকাংশ মুসলমান, কংগ্রেসের ডাকে প্রবল সাড়া দিয়েছিল, কংগ্রেসকে মনে করেছিল নিজের জিনিস। তেমন ঘটনা পূর্বে কখনও ঘটেনি। এই অভূতপূর্ব অবস্থার সুযোগে বাংলার কংগ্রেসের নেতারা বাংলার রাষ্ট্ৰীয় বুদ্ধি ও আন্দোলনকে ধর্মভেদের নাগপাশ থেকে মুক্তি দেবার কোনও চেষ্টাই করেননি। নিজেদের শ্রেণিগত স্বার্থের চিন্তা তাদের বুদ্ধিকে অন্ধ ও কর্মকে পঙ্গু করেছিল। বাংলার চাষির অনায়াসলভ্য নেতৃত্ব বাংলার কংগ্রেসের পক্ষে অসাধ্য হয়েছিল। ১৯২৮ সালের আইন-সংশোধন ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ হল বাংলার আইনসভার কংগ্রেসী সভ্যদের কাছে চাষির স্বার্থের চেয়ে জমিদারের স্বাৰ্থ বড়। এই প্ৰস্তাবিত আইনের আলোচনায় স্বরাজ্যদলের এক বৈঠকে একজন বিখ্যাত নেতা বলেছিলেন যে, গাছ কেটে নেবার যে টোনা স্বত্ব চাষিকে দেওয়া হল it will strike their imagination, অর্থাৎ তাতেই বাংলার চাষিরা বাংলার কংগ্রেসের চাষি-হিতৈষণার মুগ্ধ থাকবে। বাংলার চাষি চাষা বটে, কিন্তু অতটা বোকা নয়। এর পর বাঙালি চাষির আনুগত্য বাংলার কংগ্রেস আর ফিরে পায়নি। কিন্তু জমিদারের স্বার্থরক্ষার এই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত বিফল হল। ১৯২৮ সালের বিধান বেশিদিন টিকে থাকল না। অর্থাৎ বাংলার কংগ্রেসের পিয়াজ ও পয়জার দু-ই হল।
বিলাতের পার্লামেন্ট ১৯৩৫ সালের ভারত-শাসন আইন প্রণয়ন ও পাশ করলেন। এই আইনের কমু্যুনাল প্রতিনিধি ও কমু্যুনাল নির্বাচনের ব্যবস্থায় বাংলার আইনপরিষদে মুসলমান সভ্যেরা হলেন সবচেয়ে দলে ভারী। আর, এ সভ্যদের বেশির ভাগ নির্বাচিত হলেন মুসলমান চাষির ভোটের জোরে। সুতরাং, এবারকার আইনসভায় চাষির দাবি অগ্রাহ্য করে চলা আর সম্ভব হল না। ১৯৩৮ সালে ১৮৮৫ সালের টেনেসি আইন আবার সংশোধন হল। ১৯২৮ সালের আইনে চাষিরা গাছ কেটে নেবার, জমিতে ইচ্ছামতো পুকুর কাটবার ও পাকা বাড়ি তোলার যে সব স্বত্ব পেয়েছিল তা বহাল রইল। কিন্তু এবারের আইনে জমি বেচা-কেনার অধিকার হল নির্বাধি ও নিরুপদ্রব্য; ১৯২৮ সালের আইনে দেওয়া জমিদারের নজর পাওয়ার স্বত্ব ও ক্রেতার কাছ থেকে কিনে নেবার স্বত্ব দু-ই বাতিল হল। জমিদার যেমন তার জমিদারি বিক্রি করতে পারে, গভর্নমেন্টের কোনও দাবিদাওয়ার ভয় না রেখে, চাষিও তার জমি বিক্রির স্বত্ব পেল জমিদারের কোনও দাবি মেটাবার দায়ে না থেকে। চাষের জমির খাজনা বাড়াবার পূর্বের বিধি আইনের পৃষ্ঠায় বহাল থাকল বটে, কিন্তু বিধান হল ১৯৩৭ সাল থেকে দশ বছরের জন্য ও-সব বিধির প্রয়োগ বন্ধ থাকবে, অর্থাৎ ওই সময়ের মধ্যে জমির খাজনা আর বাড়ানো চলবে না। এই সাময়িক বাধা যে জমিদারের খাজনা বাড়াবার স্বত্বের লোপ বা বিশেষ সংকোচের সূচনা, তাতে কারও সন্দেহ নেই। এবং এই লোপ বা সংকোচের আইন বিধিবদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত ওই দশ বছরের মেয়াদ যে মাঝে মাঝে আইন করে বাড়ানো হবে, তাও নিঃসন্দেহ।
১৮৮৫ সালের টেনেন্সি আইন পাশের প্রাককালে কবি হেমচন্দ্ৰ লিখেছিলেন–
টেনেন্সি বিল নামে আইন হচ্ছে তৈয়ার করা,
গয়া গঙ্গা গদাধর ভূস্বামী প্রজারা।
অর্থাৎ, ও আইনে চাষের জমিতে জমিদারদের মালিকি স্বত্বের গয়াশ্রাদ্ধ হয়ে গেল। সে আইনে তেমন কিছুই হয়নি, মাসিক শ্ৰাদ্ধও নয়। কিন্তু ১৯৩৮ সালের আইনে গায়াশ্রাদ্ধ হয়ে জমিদারের মালিকি স্বত্বের প্ৰেতাত্মা দূর না হোক, সে স্বত্বের যে সপিণ্ডীকরণ হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। বস্তুকে ইচ্ছামতো অগুন্তি রকমে ব্যবহারে লাগাবার অধিকার যদি হয় মালিকি স্বত্ব তবে বাংলাদেশের চাষের জমিতে মালিকি স্বত্ব মোটামুটি এসেছে চাষির হাতে, নির্দিষ্ট খাজনা পাবার অধিকার ছাড়া আর বেশি কিছু অধিকার জমিদারের অবশিষ্ট নেই। ১৯১৯ সালের ভারতশাসন আইনের সমসাময়িক রােয়ত-আন্দোলনে চাষিদের পক্ষে যে সব দাবি উপস্থিত করা হয়েছিল, ১৯৩৮ সালে তার প্রায় সমস্তই পূরণ হয়েছে। কিন্তু বাংলার চাষির গোয়াল যদি গোরুতে ভরতি হয়ে থাকে, আর তার গোলা যদি ধানে বোঝাই হয়ে গিয়ে থাকে–তার একমাত্র কারণ, সে গোয়াল ও গোলা নিতান্তই ছোট; পূর্বেও ছিল, এখনও আছে। চাষের জমির মালিকি স্বত্ব পেয়ে বাংলার চাষির আর্থিক দুৰ্দশা কিছুই ঘোচেনি। সোনার বাংলা কবিতা ও গানের ‘সোনার বাংলা’ রয়ে গেছে।