অবনী বলল, আজ আর ম্যালে গিয়ে কাজ নেই।
শিপ্রা বলল, তুমি একবার ঘুরে এসো।
অবনী কি ভাবল, বলল—তাহলে তুমিও চল।
দুপুরের আগেই শিপ্রার সঙ্গে অবনীও শীতে কাঁপতে কাঁপতে ম্যালে এসে পৌঁছল। তাদের নির্দিষ্ট বেঞ্চে দুজনে পাশাপাশি বসল।
দুপুর হয়ে গেল।
একটু পরেই ভুটানী তার ঘোড় নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। সেই পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত ঢাকা কালো জিনের কামিজ, বুক আর গলা সাদা। গাল দুটো আজ যেন একটু বেশী লাল। দুটো ঠোঁট এত বেশী লাল, মনে হয় যেন রক্ত চুইয়ে পড়ছে।—ঘঘাড়েকে পর চড়েঙ্গে বাবু।
শিপ্রা কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বলল—আজ ম্যাল খুব নির্জন—এমন সুযোগ আর পাবে না—যাও!
অবনীর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। শিপ্রার মুখের দিতে তাকাতে পারছে না।
পাহাড়ী সেই যুবতী যেন জেনে গেছে অবনী আজ সওয়ার হবেই। তার চোখের মণিদুটো চকচক করছে। সাদা দাঁতের সারি মেলে হাসতে হাসতে বলছে, চড়েঙ্গে বাবুঘোড়া বহুৎ বেইরিন হ্যায়।-আইয়ে—আইয়ে না!
কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল অবনী। সম্মোহিতের মতো ঘোড়ার কাছে এগিয়ে গেল। দুহাতে ঘোড়ার কাঁধটা আঁকড়ে ধরে লাফিয়ে উঠে পড়ল পিঠে।
তারপর শিপ্রার দিকে আর ফিরে তাকাবার সময় পেল না। কোনমতে লাগামটা শুধু ধরতে পেরেছিল। পা দুটোও ঠিকমতো রেকাবে রাখতে পারেনি, তার আগেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছিল ভুটানী।
একটু অভ্যস্ত হওয়ার পরেই অবনী একবার পিছনে ফিরে তাকিয়েছিল শিপ্রাকে দেখবার জন্যে। কিন্তু ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছে শিপ্রা। সেই ভুটানী যুবতী ঘোড়ার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে ছুটে চলেছে। তাকে পিছনে ফিরতে দেখে যুবতী তীক্ষ্ণস্বরে সতর্ক করে দিল—পিছে মত দেখিয়ে বাবু-সামনে দেখিয়ে!
অবনীর আর একটুও শীত করছে না। বুঝতে পারছে ঘামে ভিজে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে গেছে। ভেতরটা কাঁপছে ভীষণ। রাস্তার বাঁদিকে গভীর খাদ। ডানদিকে ঘন জঙ্গলি জঙ্গলের মধ্যে জমাট কুয়াশা। সামনে কিছুই দেখা যায় না, শুধু কুয়াশা!
শুধু ঘোড়ার খুঝের শব্দ। না সেই শব্দ অবনীর বুকের হৃদপিণ্ডের। ভীষণ জোরে, সশব্দে আর অসম্ভব দ্রুত ওঠানামা করছে অবনীর বুক। উত্তেজনায়, রোমাঞ্চে, আতঙ্কে এক অনির্বচনীয় অনুভূতিতে অবনীর সারা শরীর অদ্ভুত কাঁপছে। সেই অনুভূতি সহ্য করতে পারছে না সে। তার মনে হচ্ছে, মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো ছিঁড়ে যাবে, হৃদপিণ্ড বিদীর্ণ হয়ে যাবে। একবার মনে হয় চীৎকার করে বলে, ভুটানী ঘোড়া থামাও, ঘোড়া থামাও, আমি নেমে যাব—ঘোড়া থামাও—আমাকে নামিয়ে দাও। লাগাম তার নিজেরই হাতে, অবনীর একবারও তা মনে পড়ল না।
এক যুগ পরে যেন অবনী ম্যালে এসে পৌঁছল। মাটিতে পা দিয়েই ছুটে গেল দেখতে শিপ্রা কোথায়, কেমন আছে. দেখে শিপ্রা সেই বেঞ্চেই বসে আছে। শুধু আরো বেশী কুয়াশা শিপ্রাকে ঘিরে।
শিপ্রার মুখ আরো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ঠোঁট দুটো আরো সাদা চোখদুটো আরো ঘোলাটে। অবনীকে দেখছে, যেন অন্য কাউকে দেখছে। কথা বলছে না। কথা বলতে পারছে না।
অবনী কি করবে বুঝতে পারে না। মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে…ডাকে শিপ্রা আমি এসে গেছি। তোমরা কি কষ্ট হচ্ছে আমাকে বল। শিপ্রা, তোমার কি হয়েছে?
ঠোঁটদুটো একটু নড়ে। খুব ক্ষীণ স্বরে, যেন অনেক দূর থেকে শিপ্রা বলে শরীর খারাপ লাগছে—ঘরে চল।
অবনী তাড়াতাড়ি শিপ্রার হাত ধরে।—ওঠ। হেঁটে যেতে পারবে?
শিপ্রা তার শীর্ণ ঘাড়টা নাড়ে।—পারব।
হোটেলে পৌঁছবার আগেই বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টি নয়, গায়ে বিধতে লাগল বরফের তীক্ষ্ণ কুচি। পথেই একটা বিপর্যয় ঘটে যেতে পারত। অবনী কোন মতে শিপ্রার শরীরটাকে হোটেলে নিয়ে তুলল।
বরফের মত শরীরটাকে বিছানায় তুলে দিয়েই অবনী ফায়ার প্লেসের দিকে ছুটে গেল।
দু মিনিটের মধ্যেই আগুন জ্বলে উঠল।
দেখতে দেখতে শিপ্রা স্বাভাবিক হয়ে উঠল। ঠোঁটদুটো সাদাই রইল, কিন্তু গলায় অর ফিরে এল।
শিপ্রা প্রথমেই বলল—আমি আর বাঁচব না।
অবনী কাছেই একটা চেয়ারে বসে ছিল আগুনের দিকে চেয়ে, চমকে ফিরে তাকাল।
শিপ্রা বলল—আমি এবার ঠিক মরে যাব।
অবনীর নিজের শরীরটাও ভালো ছিল না, কেমন অসুস্থ লাগছে। নিজের শরীরটাকে মনে হচ্ছে যেন অন্য কারো শরীর। তবু খুব আন্তরিকভাবে, গলার স্বরে মমতা। মিশিয়ে বলল—এসব কেন ভাবছ শিপ্রা, তোমার এমন কি অসুখ—।
শিপ্রা বলে উঠল—অসুখের কথা নয়।
তাহলে?
কেন বাঁচব আমি!
এসব কি বলছ শিপ্রা!
সত্যি কথাই বলছি। বল, আছে–ভালোবাসা—বিশ্বাস–?
কেন একথা বলছ?
তুমিই বল কেন।
—আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
তুমি ঘোড়ায় কিন্তু শেষপর্যন্ত চড়লে।
শিপ্রা!
না চড়ে পারলে না।
শিপ্রা তুমি—তুমিই তো আমাকে বাধ্য করলে। তুমি না বললে–।
আমি না বললেও তুমি–। তোমার চোখে সেই লোভ দেখেছিলাম। আমি না বললেও, একদিন খুব নগ্নভাবে লোভটা তুমি প্রকাশ করতে। বল, তাই করতে কি না। বল!বলতে বলতে উত্তেজনায় শিপ্রা বিছানায় উঠে বসে। তার শুকনো সাদা মুখ অদ্ভুত লাল হয়ে উঠেছে যেন তার ভেতরে আগুন জ্বলছে।
অবনীর বুকের মধ্যেও আগুন ধরে যায়। দারুণ আক্রোশে কয়েকটা শুকনো কাঠ সে জ্বলন্ত চুল্লিতে ছুঁড়ে দেয়।
দ্বিগুণ বেগে আগুন জ্বলে ওঠে।