অবনী তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে আসে ম্যালে শিপ্রার কাছে। এসে দেখে শিপ্রার চোখে-মুখে দারুণ উৎকণ্ঠা। স্পষ্ট বোঝা যায় শিপ্রা দারুণ ভয় পেয়েছে।
—কি হয়েছে?
শিপ্রা ক্ষীণ স্বরে বলে, আমার ভয় করছে।
কেন, ভয় কিসের?
জানি না তুমি অতদূরে যেও না।
দূরে তো যাই নি।
আর যেও না কখনো। আমাকে একা রেখে তুমি কোথাও যাবে না। বল যাবে না!
পরের দিন থেকে অনী ম্যাল ছাড়িয়ে কোথাও যায় না। শিপ্রার পাশে, বেঞ্চে বসে থাকে। দুপুর গড়িয়ে যায়, বিকেল হয়। সন্ধে হয়ে আসে।
সকালেই ঘোড়াগুলো চলে আসে ম্যালে। লম্বায়, চওড়ায় খুব বড় নয় মোটেই ঘোড়াগুলো। পাহাড়ী মানুষজনের মতো আকারে ছোট। শক্ত হাড়ের ওপর মেদ মাংস চামড়ার শক্ত বাঁধুনিতে পাহাড়ী সুষমা সুস্পষ্ট। পিঠে জিন লাগানো, মুখে লাগাম। ঘোড়াগুলো ঘিরে কিশোর-কিশোরী যুবক-যুবতীদের উৎসাহই বেশী, তাদেরই বেশী ভীড়। প্রত্যেক ঘোড়ার সঙ্গে আছে একজন করে ঘোড়াওআলা—যাদের বয়স বারো থেকে বাইশের মধ্যে। মলিন পোশাক আর ময়লা চামড়া দেখলেই বোঝা যায় ভুটানী বস্তির ছেলেমেয়ে, এরা ঘোড়ার মালিক নয়।
ঘোড়ার মালিক কেউ ঘোড়া নিয়ে ম্যালে আসে না সওয়ার ধরতে এমন নয়। নোংরা পোষাক, রুক্ষ চুল, অপরিচ্ছন্ন চামড়ার মাঝখানে দু একজনকে দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায় ঘোড়ার মালিক। কালো রঙের জিনের ভুটানী কামিজ, গোড়ালি থেকে গলা পর্যন্ত, বুক আর গলার কাছে কাপড়ের রং সাদা। লাল ফিতে দিয়ে বিশেষ ঢঙে বাঁধা চুল বিনুনী করে কোমরে নীচ পর্যন্ত নামানো। একটু ভারী নিটোল নিতম্ব। চওড়া কঠিন কাঁধ যেন ছুরি দিয়ে গাঁথা। নাকটা একটু চাপা, চোখদুটো ছোট, মণিদুটো নীল, নীলার মতো। দুটো গাল লাল রক্তাভ। বুকে সাদা জিনের তলায় দুটো তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা লুকোনো।
একটা সাদা রঙের সুন্দর ঘোড়া নিয়ে রোজ দুপুরে সে অবনীর সামনে এসে দাঁড়ায়। রোজই তার এক কথা-ঘোড়াকে পর চডেঙ্গা বাবু?
অবনী কোন উত্তর দেয় না।
কিন্তু উত্তর না নিয়ে সে নড়বে না। দাঁড়িয়ে থাকবে আর লাল ঠোঁটে মোহিনী হাসি ফুটিয়ে প্রলুব্ধ করতে থাকবে।
শিপ্রা নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হয় সেই ভেবেই অবনী বিরক্ত হয়ে বলে—ম্যায় ঘঘাড়েকে উপর নেই চড়না চাতা।
ঝকঝকে সাদা করাত্রে মতো দাঁত্রে সারি মেলে হাসতে হাসতে বলে—এ বাবু, ডরো মত-মেরা ঘোড়া বহুৎ বেইরিন হ্যায়।
আপ দুসরা আদমী কে পাস যাইয়ে। একটু বেশী রুক্ষভাবেই কথাটা বলা হয়ে যায়। অবনীর নিজের কানেই খারাপ লাগে। লাগুক শিপ্রা নিশ্চয়ই খুব খুশী হয়।
শিপ্রার কিন্তু অন্য সুর। বলে—আহা। বেচারা রোজ তোমার কাছে আসে, একদিন চড়লেই পার ওর ঘোড়ায়।
পাগল হয়েছ।
কেন, কি হয় চড়লে।
ভেবেছ একবার চড়লে তারপর ও ছেড়ে দেবে–।
তোমার যদি ইচ্ছা হয় রোজ একবার করে না নয় চড়বে!
অবনী বলে, আমার ইচ্ছা করে নাকে দেখে ফেলবে কি ভাববে।
শিপ্রা বলে—কে তোমাকে দেখছে!
অবনী বলল—তুমি তো দেখবে।
শিপ্রা বলল—দেখতে ভালোই লাগবে আমার।
মোটেই ভালো লাগবে না।
ভালো লাগবে বলছি—তুমি চড়েই দেখ না।
না–।
না কেন, কোনদিন কি চড়োনি, ছেলেবেলায় কোনদিন—।
অবনী বলল—এখন তো আর ছেলেমানুষ নই।
শিপ্রা বলল বুড়োও ত হয়ে যাওনি।
অবনী আর কোন কথা বলে না। চুপ করে থাকে।
শিপ্রা কিছুক্ষণ পরে বলল কি ভাবছ, কথা বলছ না।
অবনী শিপ্রার চোখের দিকে তাকায়। তার কেমন সন্দেহ হয়। শিপ্রার চোখ দুটো এত নিরীহ, এত নিপ্রাণ, কোন অনুভূতিই যেন নেই। যেন পাথরের চোখ।
অবনীর বুকের মধ্যে, কোথায় কোন শুষ্ক ধূসর উপত্যকায় একটা পুরোনো আক্ষেপ আবার কুণ্ডলি পাকাতে থাকে।
এই সময় মেঘ উঠে আসে ম্যালে। নিমেষে বিকেলের সবটুকু আলো শুষে নেয়। হিমেল কুজঝটিকায় চারদিক ঢেকে যায়। শীতের কামড় চামড়া কেটে হাড়ে পৌঁছতে থাকে।
অবনী তাড়াতাড়ি শিপ্রাকে হোটেলে ফিরিয়ে আনে।
হোটেলের ঘর তখন যেন হিমঘর।
কার্ডিগানের ওপর প্রম শাল, তার ওপর দুটো পাহাড়ী কম্বল, তাতেও শিপ্রা হাত পা গরম হয় না, কাঁপুনি থামে না। ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাতে হয়।
দেবদারুর শুকনো ডাল জ্বলতে থাকে দাউ দাউ করে। অবনী ফায়ার প্লেসের সামনে একটা চেয়ার নিয়ে বসে। মাঝে মাঝে দু একটা করে কাঠের টুকরো আগুনে ফেলে। অবনীর বিশাল ছায়া শিপ্রার বিছানা ছাড়িয়ে পিছনের দেয়ালের ওপর। দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে শিপ্রা। শরীরে তাপ ফিরে এসেছে। অবনীর অনুমান, শিপ্রা ঘুমিয়ে পড়েছে।
হোটেলের বেয়ারাকে দিয়ে খাঁটি ভুটানী ব্রাণ্ডি আনিয়েছে অবনী, শিপ্রা জানে না। শিপ্রা ঘুমিয়েছে, আরো কিছুক্ষণ পরে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে, অবনী উঠে গিয়ে সন্তর্পণে গোপন জায়গাটা থেকে সেটা বের করে। তারপর আগুনের সামনে এসে আবার বসে।
ম্যালের সেই ভুটানী যুবতী তার সাদা রঙের পাহাড়ী ঘোড়া নিয়ে হেসে সামনে এসে দাঁড়ায়।
পরের দিন ভোর থেকেই আবহাওয়া আবার খুব খারাপ। দূরের গাছপালা কারে মানুষ কিছুই দেখা যায় না এত কুয়াশা। শীত চামড়া কেটে সরাসরি হাড়ে বিধছে। হাড় কন কন করছে। অবনী আগে ঘরে কিছু কাঠ আনিয়ে রাখল।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা কিছুটা কমল, কিন্তু আকাশ আরো থমথমে হয়ে এল। শিলাবৃষ্টি হতে পারে আজ।