বেশ চলছিল। সেদিন কেন মরতে অফিসে মিত্তিরদের বেকার শালাকে দয়া করে পিওরসিল্ক শাড়িটা কিনতে গেল। মিত্তিরদাই বললেন,
—চ্যাটার্জী, বউ-এর জন্য তো এবছর কিছুই হাতে করে নিয়ে গেলে না। বউ ভালবাসবে কি করে? শাড়িটা গিয়ে নিয়ে বউ এর একটু মন ভোলাও। টাকা না হয় তুমি যখন ইচ্ছে দিও।
সত্যিই তাই। সত্যি বলতে কি কনাদ নিজের, আর কখনও সখনও ছেলের পোষাক আষাক ছাড়া কিছুই কোনদিন কেনেনি। মহিলাদের জিনিস পছন্দের ব্যাপারে ও ভীষণ অজ্ঞ। বিয়ের পর প্রথম দিকে দোকানে গিয়ে ও যে শাড়িটা পছন্দ করতে এষা মিষ্টি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলতো,
দূর, ঐ শাড়ি এখন আর চলে না। ব্যক ডেটেড্।
শরীরের চড়াই উত্রাই ফুটিয়ে তোলা শাড়ি পছন্দ করে এষা ডগমগ হয়ে ফিরতো। কনাদ মনে মনে আহত হলেও নিজেদের প্রাচীন পন্থী, রক্ষণশীল ভেবে ব্যাপারটা মেনে নিত।
মেনে না নিলেই কি চলে নাকি? এষার উৎসাহেই স্নিগ্ধ সাঁতারে ডিস্ট্রিক্ট রানার্স, নেতাজি ইন্ডোরে ছবি আঁকতে যায়, বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশানের মতো স্কুলে স্ট্যান্ড করে, ক্রিকেটটাও মোটামুটি খেলছে। পাশের বাড়ির আকিঞ্চন বাবুদের বাড়িতেই স্নিগ্ধ ছোট থেকে মানুষ। আকিঞ্চন বাবুর ছোট ছেলে কণিষ্ক ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস এম.এ.। বক্স ছাব্বিশেক বয়স। রুজিরোজগারের চেষ্টায় আছে। ঝকঝকে স্মার্ট চ্যাটার্জীদা আর বৌদির বাড়িতে অবাধ গতি, যখন তখন চায়ের আবদার। স্নিগ্ধর পড়াশোনার সব দায়িত্ব ওর। যেহেতু, স্নিগ্ধর ও কোকো কাকু তাই মাইনে কড়ির ব্যাপারই নেই। অবশ্য এষাও আকিঞ্চনবাবুদের সঙ্গে আত্মীয়ের মতো মেশা, খাবার দাবার, পুজোয় জামাকাপড়-যতটা পারে করে।
শরীরটা বেশ অবশ হয়ে আসছে। একটা ঘোরের মতো। কিন্তু সেই পরশু দুপুরের কথা মনে পড়লেই সব আলস্য কেটে গিয়ে এক হাহাকারের যন্ত্রণা। চাবুকে ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে। গ্লাসটা টেনে নেয় কনাদ। স্বপ্নের মতো আচ্ছন্নে ভেসে আসছে রম মুহূর্তটা।
শাড়ির প্যাকেট হাতে গলির মুখ থেকে দেখেই কনা বুঝল এ বাড়িতে আছে। দরজা ভেজ্ঞ থেকে বন্ধ। কনাদ আজ পর্যন্ত আগাম না জানিয়ে বাড়ি ফেরেনি। এই সময়ে এষা স্নিগ্ধর ক্যারিয়ারের ব্যাপারে মানুষ তৈরির বিভিন্ন পীঠস্থানে যায়। যদিও কনাদের কাছে ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি থাকে, তু একলা চাবি খুলে ঢুকলে ফ্ল্যাটটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সেইজন্য কনাদ ব্যাপারটা এড়িয়ে থাকে।
না, আজ এষাকে সারপ্রাইজ দিতে হবে। হয়তো ভাতঘুম দিচ্ছে। পেছনের গলি দিয়ে গিয়ে শাড়িটা জানালা গলিয়ে ফেলে দিতে হবে। আজকাল স্নিগ্ধ বড় হয়ে। যাবার জন্য এষাকে ঠিকমতো কাছে পাওয়া যায় না। আজ মিন্ধর ক্লাস পরীক্ষা আছে। ও এখন স্কুলে। অনেকদিন পর সেই বিয়ের প্রথম দিকের দিনগুলোর মতো কনাদ এষাকে নিয়ে হারিয়ে যাবে। যেমন বিয়ের পর পরই মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে দুপুরবেলা অফিস থেকে চলে এসে দু-জনে হারিয়ে যেত।
পেছনের গলিতে ঢুকতেই পচা সড়ির গন্ধ নাকে। রুমালে মুখ ঢেকে এগোতেই ডান পা-টা নর্দমা থেকে ওঠানো আপাত শক্তপাঁকে। ব্যাজার মুখে ভাল করে ঘাসে পা মুছে কনাদ এগিয়ে যায়। জানালা আর পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে চোখ যায়। কণিষ্কের খালি বুকে আঁকিবুকি কাটছে এষা। জড়ানো স্বরে বলছে,
—ঐ লাল কালো স্ট্রাইপ জামার কাপড়টা তোমার। ঐ রং আধবুড়োটাকে মানায় নাকি?
কনাদ আর দেখতে পারে না, পা দুটোয় কেউ যেন সিসের বস্তা বেঁধে দিয়েছে। চলার শক্তি নেই। বিধ্বস্ত কনাদ আস্তে আস্তে গলির বাইরে বেরিয়ে আসে। চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে,
আমি মদ খেয়ে চুর হয়ে যাব। আমার টাকা আছে। আমি মেয়েছেলে পুষব। আমি, আমি মরে যাব।
হা কনাদ মরেই যাবে। তবে নিজে মরে ওদের বাঁচিয়ে দিয়ে যাবে না। চরম শাস্তি দেবে। যাতে ওরা মাথা তুলে বাঁচতে না পরে। ও পালিয়ে যাবে। যেখানে ওর লাস কেউ খুঁজে পাবে না। ওর ডেডবডিই যদি না পায়, তাহলে ডেথ সার্টিফিকেটও পাবে না। পি.এফ.গ্র্যাচুইটি, জমানো টাকা, চাকরিকাউকে ও ভোগ করতে দেবে না।
হিমালয়ের কোলে গঙ্গা অলকানন্দার সঙ্গমে ওর পরিচয় কেউ জানে না। কিছুক্ষণ পরে ও শুধুই একটা আনক্লেমড্ লাশ হয়ে যাবে। ঠাণ্ডা ঘরে কটাছেঁড়ার পর কিছুদিন বাদে গাদার মড়া হয়ে জ্বলে যাবে। অবশ হাতটা বাড়িয়ে অনেক কষ্টে জোগাড় করা তিপ্পান্নটি স্লিপিং পিলের শিশি থেকে আরও দুটো মুখে দেয় কনাদ।
আবছা ভাসছে ছোট্ট স্নিগ্ধর হাঁটি হাঁটি পা মুখটা। অপেক্ষার স্নিগ্ধর উপনয়নের উৎসবের স্বপ্ন এষার গ্রিল ধরা উদগ্রীব মুখ। কণিষ্কর লোলামশ বুকে এষার ফর্সা হাত।
—এষা, কেন তুমি…
হাতটা জলের গ্লাসের কাছে পৌঁছায় না। আস্তে আস্তে চোখ দুটো বুজে আসে কনাদের।