মুখটা বিকৃত করিয়া মোহিত কহিলেন, কে জানে কি লেখা, আমি কি আর কোনটা পড়েছি ছাই! তুমিই খালি ওঁর নাম করতে গ’লে পড়ো।
হ্যাঁ গো মশাই, শুধু বুঝি আমি? ভালোই যদি না হবে, তাহ’লে অতগুলো মাসিক-পত্র ওঁর লেখা ছাপে কেন?
মোহিতবাবু একটা তাচ্ছিল্যসূচক শব্দ করিয়া কহিলেন, হাঁ, ওদের তো ভারী বুদ্ধি, ওরা যা পায় তাই ছাপো…তোমারও যেমন খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই, যতগুলো কাগজ অরুণবাবুর লেখা ছাপে, সবগুলোই তো তুমি নিতে শুরু করেছ দেখছি।
কি করব, একলা সময় কাটে কি করে আমার? তুমি কিছু ভেবো না, নিশ্চয় ভাল বিক্রি হবে সব কাগজে পাঠিয়ে দাও, দেখবে, ভাল আলোচনা বেরুলেই বিক্রি হতে শুরু হবে।
হ’লেই বাঁচি। একেবারে নতুন লেখক, ভয় করে বড্ড।
মোহিতবাবু খানিকটা চোখ বুজিয়া পড়িয়া রহিলেন। একটু পরে রামটহল তামাক দিয়া যাইতে উঠিয়া বসিয়া গড়ার নলটা হাতে তুলিয়া লইয়া কহিলেন, হ্যাঁ, আর একটা ভারী মজার ব্যাপার বলতে ভুলে গেছি। শুনেছ, ওঁর বউয়ের নামও নীলিমা।
নীলিমা হেঁট হইয়া জলখাবারের থালা রাখিতেছিল, অকস্মাৎ তাহার হাতটা কাঁপিয়া উঠিল, প্রশ্ন করিল, কে বলেছে?
মোহিতবাবু জবাব দিলেন, ওই দেখ না বইটা খুলে, উৎসর্গ করেছেন তার নামে।
নীলিমা তাড়াতাড়ি বইটা খুলিয়া উৎসর্গ পৃষ্ঠাটা বাহির করিল। মিনিট খানেক সেদিকে নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিল, কিন্তু ও যে ওঁর বউয়ের নাম, তা তুমি কেমন ক’রে জানলে?
মোহিতবাবু মুখ হইতে নলটা সরাইয়া বলিলেন, নামটা দেখে ভারী মজা লাগল। বলতে তো পারি না কিছু, ওঁকেই জিজ্ঞাসা করলাম, ইনি কে মশাই? অরুণবাবু জবাব দিলেন, আমার স্ত্রী।’ অদ্ভুত মিল, না?
নীলিমা কোন উত্তর দিল না। তখনও তাহার চোখের সামনে সেই উৎসর্গ পৃষ্ঠাটা ভোলা, কিন্তু অক্ষরগুলি তখন আর চোখে পড়িতেছিল না, সব যেন তাহার দৃষ্টির সম্মুখে লেপিয়া মুছিয়া একাকার হইয়া গিয়াছিল।
আরও মিনিট দুই পরে বইটা বন্ধ করিয়া সে ঈষৎ রুদ্ধ-কণ্ঠে কহিল, বস, তোমার চা-টা নিয়ে আসি—
কিন্তু তখনই সে নীচে গেল না। ওপাশের বারান্দায় দাঁড়াইয়া অনেকক্ষণ গলির উপরের একফালি অন্ধকার আকাশের দিকে নির্নিমেষ নেত্রে চাহিয়া রহিল। তাহার পর কে জানে কাহার উদ্দেশ্যে হাত তুলিয়া নমস্কার করিল।
মোহিতবাবু ততক্ষণে ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন।