তাহার পর আবার একটু একটু করিয়া সে নিজের জীবিকার ব্যবস্থা করিতে পারিয়াছে। আজ বরং তাহার অবস্থা সচ্ছলই, কিন্তু এই সচ্ছলতা একদিন যাহার জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। ছিল, দুঃখের ঘূর্ণাবর্তে তাহার সেই জীবন-সঙ্গিনীই গিয়াছে হারাইয়া। আজ আর এ স্বাচ্ছন্দ্যের যেন কোন মূল্যই নাই। কোথায় আছে সে কে জানে সুখে আছে কি আরও দুঃখে আছে! কাহার আশ্রয়ে আছে তাই বা কে জানে, সে কেমন লোক! হয়তো বা বাঁচিয়াই নাই। দুঃখে, কষ্টে, দারিদ্র্যে—হয়তো অকালেই এ পৃথিবী হইতে বিদায় লইয়াছে। কথাটা ভাবিতেই অরুণের দুই চোখ অশ্রু-পরিপূর্ণ হইয়া আসিল। বেচারী অত দুঃখই সহিল, আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরিয়া থাকিলে হয়তো আর ইহার প্রয়োজন হইত না। আজ এই স্বাচ্ছন্দ্যের সেও অংশ লইতে পারিত, আজ আর তাহার প্রথম উপন্যাস কাহাকে উৎসর্গ করিবে, এ প্রশ্ন উঠিত না। সে হয়তো আজও বাঁচিয়া আছে, অথচ এ সমস্যার মীমাংসা করিতে পারিতেছে না অরুণ কিছুতেই।
নীলিমাকেই সে উৎসর্গ করিবে নাকি শেষ পর্যন্ত? কুল-ত্যাগিনী স্ত্রীকে?
দোষ কি?
চিন্তাটা মাথায় আসিবার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন অস্থির হইয়া উঠিলা চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে না পারিয়া সঙ্কীর্ণ ঘরের মধ্যেই পায়চারি শুরু করিয়া দিল।
বেচারী নীলিমা, তাহারই বা অপরাধ কি, কি কর্মটাই না করিয়াছে সে! দিনের পর দিন নিরস্তু উপবাস করিয়াছে, লজ্জা নিবারণের কাপড়টুকু পর্যন্ত জোটে নাই। বহুদিন তাহাকে গামছা পরিয়া একমাত্র ছেড়া কাপড় শুকাইয়া লইতে হইয়াছে। তবু—তবু সে গঞ্জনার একটি শব্দও মুখ দিয়া উচ্চারণ করে নাই, কোন প্রকার অনুযোগ করে নাই, আবার স্বামী খাইবে বলিয়া সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছে। শেষ পর্যন্ত যদি সে একদিন দুর্বল হইয়া পড়িয়াই থাকে তো এমন কিছু অপরাধ নয়।
অরুণ তাহার মনের মধ্যে বহু দূর পর্যন্ত দৃষ্টি মেলিয়া দিয়া, আজ বোধ করি প্রথম, লক্ষ্য করিল যে, সেখানে নীলিমার সম্বন্ধে কোন অভিমান, কোন অনুযোগই আর অবশিষ্ট নাই। হয়তো আছে বেদনা-বোধ, কিন্তু তাহার জন্য দায়ী তাহার নিজেরই অদৃষ্ট। যতদিন নীলিমাকে সে পাইয়াছে, কখনও কোনও অভিযোগের কারণই তো সে ঘটিতে দেয় নাই। স্নেহে, প্রেমে, সেবায়, লীলাচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ তাহার সেই কিশোরী বধূর কথা মনে পড়িলে আজও সারা দেহে রোমাঞ্চ হয়। না, যতদিন সে পাইয়াছে, আশ মিটাইয়া পাইয়াছে। এমন দুর্ভাগ্য খুব অল্প লোকেরই হয়। বটে, কিন্তু এমন সৌভাগ্যও কদাচিৎ দেখা যায়। প্রথম যৌবনের, সেই নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রার এক একটি বিনিদ্র রজনীর যে মধুস্মৃতি তাহার মনের মধ্যে সঞ্চিত আছে, শুধু সেইগুলি অবলম্বন করিয়াই তো একটা জীবন স্বচ্ছন্দে কাটিয়া যাইতে পারো তবে, তাহার কি কোন মূল্যই নাই, সেজন্য কোন কৃতজ্ঞতা নাই? অরুণের নিজের দোষে, অসীম দুঃখের ফলে, একটি মুহূর্তের দুর্বলতায় যদি তাহার পদলনই হইয়া থাকে তো সেইটাই কি সে মনের মধ্যে বড় করিয়া রাখিবে আর অতখানি প্রেম, অতখানি নিষ্ঠা সব ব্যর্থ হইয়া যাইবে? না, মনের এই দুর্বলতা, এই অন্যায় সংস্কারকে সে কিছুতেই প্রশ্রয় দিবে না, নীলিমাকেই সে প্রথম বই উৎসর্গ করিবে।
নীচে তখন রাজপথ জনবিরল হইয়া গিয়াছে, দোকান-পাটগুলি বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় আলোও হইয়া উঠিয়াছে ম্লান শহরে অশান্ত বিক্ষুব্ধতার উপরে যেন চমৎকার একটি সুষুপ্তি নামিয়া আসিয়াছে, সমস্তটা মিলিয়া একটা করুণ অথচ মধুর শান্তি।
সে খানিকটা যেন কিসের আশায় কান পাতিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। পাশের ফ্ল্যাটে তখনও স্বামী স্ত্রীর আলাপের গুঞ্জন শোনা যাইতেছে, নীচে কোথায় একটা ছেলে কাঁদিতেছে একটানা সুরে। আর সব শান্ত, স্তব্ধ।
সে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া ফিরিয়া আসিয়া আবার চেয়ারে বসিল। তাহার পর দৃঢ় হস্তে প্রফের কাগজগুলা টানিয়া লইয়া উৎসর্গ পৃষ্ঠাটি লিখিয়া দিলা বেশী কিছু নয়, শুধু—’শ্রীমতী নীলিমা দেবী, কল্যাণীয়াসু’।
পরের দিন সন্ধ্যাবেলাই বই বাহির হইয়া গেল। প্রকাশক মোহিতবাবু এক কপি হাতে করিয়া রাত্রে আসিলেন রক্ষিতার বাড়ী উপরে উঠিয়া তাহার সামনে বইখানা ফেলিয়া দিয়া কহিলেন, এই নাও, তোমার সেই বই বেরিয়েছে।
সে বসিয়া কি একটা বুনিতেছিল, তাড়াতাড়ি সেগুলি নামাইয়া রাখিয়া সাগ্রহে বইটা তুলিয়া লইল। চমৎকার বাঁধাই, উপরে রঙিন ছবি, তাহারই মধ্যে ঝকঝক করিতেছে বই ও লেখকের নাম খানিকটা নাড়িয়া-চাড়িয়া বইটা বিছানার পাশে একটা টিপয়ের উপর সযত্নে রাখিয়া দিয়া সে উঠিয়া মোহিতবাবুর স্বাচ্ছন্দ্যের তদ্বিরে মন দিল। চাদর ও জামাটা খুলিয়া তাহার হাতে দিতে দিতে মোহিতবাবু বলিলেন, বাবা বাঁচলাম! যা তাগাদা তোমার, ওই বইটা যেন আমার সতীন হয়ে উঠেছিল!
তাহার পর নীচের ঢালা বিছানাটায় দেহ এলাইয়া দিয়া কহিলেন, রামটহল গেল কোথায়? একটু তামাক দিতে বলো। …বেরুল তো, এখন খরচাটা উঠলে বাঁচি। তোমার কথা শুনে একগাদা টাকা দিয়ে বইটা নিলাম, ওর আদ্ধেক টাকাও কেউ দিত না।
ও পক্ষ তখন কি একটা কাজে ব্যস্ত ছিল, মুখ না ফিরাইয়াই কহিল, নিশ্চয়ই উঠবে। অত ভাল লেখা, লোকে নেবে না?