অরুণ আর আলো জ্বালিবার চেষ্টা করিল না। নীচে কোলাহলমুখর, আলোকোজ্জ্বল রাজপথের। দিকে চাহিয়া বহুক্ষণ স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর আবার চেয়ারেই আসিয়া বসিল। তাহার প্রথম বই কাহাকে উৎসর্গ করিবে—এই প্রশ্নটার সামনাসামনি দাঁড়াইয়া আজ এই সত্যটাই সে গভীরভাবে উপলব্ধি করিল যে, পৃথিবীতে তাহার কেহ নাই। আত্মীয়, বন্ধু, স্নেহভাজন কোথায়ও এমন কেহ নাই, যাহার হাতে তাহার বহু বিনিদ্র রজনীর ফল, বহু সাধনার বস্তু এই বইখানি তুলিয়া দেওয়া যায়।
অথচ আজ তাহার সবই থাকিবার কথা। মা খুব অল্প বয়সে মারা গিয়াছিলেন বটে কিন্তু বাবা সে অভাব জানিতে দেন নাই কখনই। অতি যত্নে মানুষ করিয়া বি.এ. পাশ করাইয়া অফিসেও ঢুকাইয়া দিয়াছিলেন এবং সংসারে লোকের অভাব বলিয়া অনেক খুঁজিয়া সুন্দরী পুত্রবধূও ঘরে আনিয়াছিলেন। সেদিন কিন্তু জীবনকে বেশ রঙীন বলিয়াই বোধ হইয়াছিল।
কিন্তু একটি বৎসর কাটিতে না কাটিতে কি কাণ্ডটাই না হইয়া গেল! বাবা মারা গেলেন, তাহারই মাস কয়েকের মধ্যে হঠাৎ অফিসটিও উঠিয়া গেল। সেই যে চাকরি গেল—আর কিছুতেই কোথাও কোন কাজ মিলিল না। এক মাস, দুই মাস করিয়া বৎসর, ক্রমে দুই বৎসর। কাটিয়া গেল। বাবা বিশেষ কিছুই রাখিয়া যাইতে পারেন নাই, সুতরাং একে একে নীলিমার গহনাগুলি সব গেল। তাহার পর ঘরের আসবাব-পত্র, সর্ব শেষে বাসন-কোসনও আর রহিল না। মধ্যে মধ্যে দুই একটি ছোটখাটো টিউশনি হয়ত পায় কিন্তু সেও পাঁচ সাত টাকার মাত্র। তাহাতে খাওয়া পরা বাড়ী-ভাড়া সবগুলি চলে না। তাই বাড়ী ছাড়িয়া সে ফ্ল্যাটে আসিল। সেখান হইতে ভাড়াটে-বাড়ীর নীচের তলায় একখানা অন্ধকার ঘর, তবু ভাড়া দেওয়া যায় না। অপমানের ভয়টা বড় বেশী ছিল বলিয়া বেশী ধার করিতে সে পারিত না। যাহা কিছু সামান্য পাইত কোন মতে ঘর ভাড়াটা দিয়া দিত, সুতরাং নিজেদের ভাগ্যে দিনের পর দিন চলিত উপবাস
উঃ, সে দিনের কথা মনে করিলে আজও বুকের রক্ত হিম হইয়া যায় শুধু নৈরাশ্য ও তিক্ততা এতটুকু আশা, এতটুকু আনন্দের আলোও কোথাও নাই। সারাদিনই প্রায় কাজের চেষ্টায় ঘুরিত। গভীর রাত্রে ক্লান্ত দেহ ও মন লইয়া বাড়ী ফিরিয়া দেখিত, হয়তো নীলিমা তখনও শুষ্ক মুখে তাহার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছে। আগে আগে সে প্রশ্ন করিত, নয় তো একটু ম্লান হাসিত, ইদানীং তাহাও আর পারিত না উপর্যুপরি উপবাসে তাহার প্রাণশক্তি গিয়াছিল ফুরাইয়া। দিনের পর দিন এই একই ঘটনা ঘটিয়াছে, তবু একটি কুড়ি টাকা মাহিনার চাকরিও সে জোটাইতে পারে নাই।
অরুণের আত্মীয়-স্বজনরা দারিদ্র্য দেখিয়া বহুদিনই ত্যাগ করিয়াছিলেনা নীলিমারও বিশেষ কেহ ছিল না। অসামান্য রূপ দেখিয়া নিতান্ত গরীবের ঘর হইতেই অরুণের বাবা তাকে আনিয়াছিলেন। সুতরাং এক বেলা আশ্রয় দিতে পারে, খাদ্য দিতে পারে, শেষ পর্যন্ত এমন কেহই যখন আর রহিল না, তখন কোন প্রকার ধার করা বা সাহায্য চাওয়ার চেষ্টাও অরুণ ছাড়িয়া দিল। এরপর চলিতে লাগিল শুধু উপবাস। দুই দিন, তিন দিন অন্তর হয়তো ভাত জোটে, তাও এক বেলা।
অবশেষে নীলিমা আর সহিতে পারিল না। আশ্রয় দিবার আত্মীয় ছিল না বটে, কিন্তু রূপ যথেষ্ট ছিল বলিয়া সর্বনাশ করিবার লোকের অভাব ঘটিল না। অরুণের চরম দুর্দিনে, তাহার ভার বহন করিবার দায়িত্ব হইতে মুক্তি দিয়া নীলিমা একদিন চলিয়া গেল। যাইবার সময় শুধু রাখিয়া গেল এক ছত্র চিঠি–
‘আমি আর সইতে পারলুম না আমাকে ক্ষমা করো। আমার ভার ঘুচলে তুমিও হয়তো এক বেলা খেতে পাবে।’
অরুণ অকস্মাৎ সোজা হইয়া দাঁড়াইল। তাহার মাথা দিয়া তখন যেন আগুন বাহির হইতেছে। সে বাথরুমে গিয়া মাথায় খানিকটা জল থাবড়াইয়া দিল, তাহার পর মুখ-হাত মুছিয়া জোর করিয়া আলোটা জ্বালিয়া প্রুফ দেখিতে বসিল। কাজ সারিতেই হইবে, বৃথা চিন্তা করিবার সময় তাহার নাই।
কিন্তু প্রফ ছিল সামান্য, শীঘ্রই শেষ হইয়া গেল। আবার সেই উৎসর্গের প্রশ্ন সামনে কাগজগুলা খোলাই পড়িয়া রহিল, টেবিল-ল্যাম্পের আলোটা নিঃশব্দে জ্বলিতে লাগিল, সে জানালার মধ্য দিয়া রাস্তার উপরে আর একটা বাড়ীর কার্নিস, যেখানে এক ফালি চাঁদের আলো আসিয়া পড়িয়াছে, সেই দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিলা মন তাহার চলিয়া গিয়াছে তখন কত দূরে, অতীতের এক কুৎসিত কর্দমাক্ত মেঘ-ঘন দিনে যেখানে আলোর রেখা মাত্র নাই, সেদিনের কথা মনে পড়িলে আজও তাহার আত্মহত্যা করিতে ইচ্ছা করে—
সেদিন হয়তো তাহার মরাই উচিত ছিল। নিজের স্ত্রী, ভরণ-পোষণের অক্ষমতার জন্য যাহাকে ত্যাগ করিয়া যায়, সে আবার সেই কালামুখ লইয়া বাঁচিয়া থাকে কি বলিয়া? কিন্তু মরিতে সে পারে নাই। হয়তো স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু আসিলে সে আদর করিয়াই বরণ করিত, কিন্তু স্বেচ্ছায় জীবনটাকে বাহির করিতে সে পারে নাই, অত দুঃখের পরেও না। বরং গৃহস্থালীর সামান্য যে দুই একটা তৈজস অবশিষ্ট ছিল, তাহাও বেচিয়া একটা মেসে গিয়া উঠিয়াছিল, এবং নিজের মনেও স্বীকার করিতে আজ তাহার লজ্জা হয়, দুই বেলা ভাত খাইতে পাইয়া সে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেলিয়াছিলা সেই হইতেই সে নিশ্চিন্ত এবং নিঃসঙ্গ।