- বইয়ের নামঃ উৎসর্গ
- লেখকের নামঃগজেন্দ্রকুমার মিত্র
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
উৎসর্গ
গজেন্দ্রকুমার মিত্র
অরুণ তাহার প্রকাশকের নিকট হইতে বাড়ি ফিরিল রাত্রি নয়টার পরে। ক্লান্তপদে তিনতলার সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া যখন নিজের ছোট ফ্ল্যাটটিতে সে চাবি খুলিয়া ঢুকিল, তখন যেন আর আলো জ্বালিবার মতও দেহের অবস্থা নাই। অবশ্য আলো জ্বালিবার খুব বেশী প্রয়োজনও ছিল না। পুবের জানালায় শুধু শার্সি দেওয়া ছিল, তাহারই মধ্য দিয়া প্রচুর চাঁদের আলো আসিয়া পড়িয়াছে, ঘরের মধ্যে প্রায় সব কিছুই আবছা দেখা যায়। সে পাঞ্জাবি ও গেঞ্জিটা খুলিয়া আলনায় টাঙাইয়া রাখিল, তাহার পর ঘরের জানালাগুলি সব খুলিয়া দিয়া একটা ক্যাম্বিসের চেয়ারের উপর দেহ এলাইয়া দিল।
নীচে তখনও কর্মমুখর কলিকাতা ঘুমাইয়া পড়ে নাই। তখনও ট্রাম-বাস পূর্ণ উদ্যমে চলিয়াছে, দোকান-পাটও সব বন্ধ হয় নাই। শহরের কর্মব্যস্ততার এই মিলিত কোলাহলে এতটা উপরে আসিয়া কেমন যেন মধুরই লাগে। নীচেকার উজ্জ্বল আলো এখানের চন্দ্রালোককে ম্লান করিতে পারে না, কিন্তু তাহার একটা রেশ এ পর্যন্ত পৌঁছায়। বেশ লাগে অরুণের এ ব্যাপারটা সে নিজের একান্ত কাছে কলরব পছন্দ করে না, কিন্তু তাই বলিয়া একেবারে নির্জনবাসেও তাহার প্রাণ যেন হাঁপাইয়া উঠো সেইজন্য ইচ্ছা করিয়াই শহরতলীতে যায় নাই, শহরের জনতামুখর এই বিশেষ ব্যস্ত রাজপথটিতেই আসিয়া ফ্ল্যাট ভাড়া করিয়াছে।
ফ্ল্যাট তো ভারি! মোট দেড়খানা ঘর। ঘর বলিতে ওই একটি, পাশে যে স্থানটি আছে তাহাকে আধখানা ঘর বলিলেও বেশি সম্মান করা হয়—চলন মাত্র, একটি ছোট টেবিল পড়িলেই আর নড়িবার উপায় থাকে না। অন্যান্য ফ্ল্যাটগুলি হইতে তিল তিল করিয়া স্থান বাঁচাইয়া এই অদ্ভুত তিলোত্তমা তাহার অদুষ্টে গড়িয়া উঠিয়াছে। অবশ্য একপক্ষে তাহা ভালই হইয়াছে বলিতে হইবে, নহিলে পনেরো টাকা ভাড়ায় একটা পৃথক ফ্ল্যাটই বা মিলিত কোথায়? অরুণের এখন যা মানসিক অবস্থা, মেসের বাসা সে কল্পনাও করিতে পারে না। অথচ শুধু একজন পুরুষকে ঘরও বড় একটা কেহ ভাড়া দিতে চায় না। আর যদি বা পাওয়া যায়, সেও বড় গোলমাল।
তাহার চেয়ে এই-ই বেশ পনেরোটি টাকা ভাড়া দেয় আর এই বাড়ীরই দারোয়ানকে দেয় সাতটি টাকা। সে-ই দুই বেলা রান্না করিয়া দিয়া যায়। হিন্দুস্থানী দারোয়ান, সুতরাং মাছ-মাংস সে খায় না, দিতেও পারে না। কিন্তু তাহাতে অরুণের বিশেষ অসুবিধা হয় না, নিরামিষই তাহার ভাল লাগে আর একটি ঠিকা ঝি আছে, সে প্রত্যহ সকালে আসিয়া ঘরের কাজ করিয়া দিয়া যায়। এই তাহার সংসার।
ইহার বেশি আজ আর সে চায়ও না, বরং এইটুকু স্বাচ্ছন্দ্য বরাবর বজায় থাকিলেই সে খুশী মাস-ছয়েক আগে এই ব্যবস্থার কথাও সে কল্পনা করিতে পারিত না। দুইটি কি তিনটি গোটা পাঁচ-ছয় টাকার টিউশনি সম্বল করিয়া যাহাকে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে হইত, মেসের দুই বেলা ভাত এবং কোনমতে কোথাও একটু মাথা গুজিবার স্থান, ওইটুকুই ছিল তাহার পক্ষে বিলাসা — একেবারে সম্প্রতি, মাত্র ছয় মাস আগে ভগবান মুখ তুলিয়া চাহিয়াছেন, চল্লিশ টাকা মাহিনার একটা মাস্টারি মিলিয়াছে এবং চাকরিটি টিকিয়া যাইবে বলিয়াই সে আশা করো অন্তত সেই ভরসাতেই সে মাস-তিনেক আগে এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া লইয়াছে।
অবশ্য শুধু মাস্টারিই আজ আর তাহার একমাত্র অবলম্বন নয়, প্রায় বছরদুয়েক আগে, গভীর বেদনা এবং নৈরাশ্যের মধ্যে, উপার্জনের আর একটি পথও হঠাৎ সে খুঁজিয়া পাইয়াছিলা খুব ছোটবেলায় স্কুলের ম্যাগাজিনে সে কবিতা ও গল্প লিখিতা এতদিন পরে মানসিক অবসাদে যখন একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছিল, তখন সে সেই পুরাতন অভ্যাসের মধ্যেই আবার সান্ত্বনা খুঁজিয়া পাইলা। এবার আর কবিতা লিখিবার চেষ্টা করে নাই, শুধু গল্প। একে। একে দু-একটি সাময়িকপত্রে সে গল্প ছাপাও হইল, ক্রমে তাহার দরুন পাঁচ টাকা সাত টাকা দক্ষিণাও মিলিতে লাগিল। সেদিন যাহা ছিল অঙ্কুর, আজ তাহাই মহীরূহে পরিণত হইয়াছে— বাংলা দেশের এক বিখ্যাত প্রকাশক একেবারে তিন শত টাকা দিয়া তাহার একখানি উপন্যাস লইয়াছেন, এবং সেটি ছাপাও প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। আজ তাহারই শেষ কয় পৃষ্ঠার প্রুফ এবং বাকি এক শত টাকার চেক প্রকাশক দিয়া দিয়াছেন।
অরুণ একবার নড়িয়া-চড়িয়া বসিল। প্রুফটা দেখিতেই হইবে, আলোটা জ্বালা দরকার। প্রকাশক মোহিতবাবু অনুরোধ করিয়াছেন, ইস্কুল যাবার পথেই তো প্রেস পড়বে, যদি কিছু মনে করেন, তাহ’লে যাবার পথে প্রুফটা প্রেসে ফেলে দিয়ে গেলে বড্ড ভাল হয়। দশটার আগে পৌঁছলে কাল ছাপা শেষ হয়ে পশু বইটা বেরিয়ে যেতে পারো।
প্রথম উপন্যাস বাহির হইবে। তাহার নিজের আগ্রহও বড় কম নয়। সে আলোটা জ্বালিবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইল।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়িয়া গেল মোহিতবাবুর আর একটা কথা, টাইটেলের চার পাতা বাদ দিয়েও আর দুটা পাতা বাঁচছে। ‘উৎসর্গ করিবার যদি কাউকে থাকে তো লিখে দিন না। প্রথম বই আপনার, কাকে উৎসর্গ করবেন ভেবে দেখুন।
কথাটা খুবই সাধারণ কিন্তু ইহার পিছনে কতখানি অপ্রীতিকর চিন্তা এবং স্মৃতিই না জড়াইয়া আছে!