সম্পাদকের এই অভিমত, এমন কি বাইরের যে কোন অভিমত, আমাদের আড্ডার নিয়মানুসারে সভার সভ্যদের Confirmation-এর (পাক্কা করণের) অপেক্ষা রাখে।
সতীপতির ইঙ্গিতে ঘর-জামাই বিলাসবন্ধু তাই নিম্নলিখিত প্রসঙ্গ উপস্থাপিত করলেন —“আপনারা সরাসরি সরেজমিনে আমাদের লেখা সম্বন্ধে সম্পাদকের উক্তি শ্রবণ করলেন এখন আপনাদের অনুমোদন প্রার্থনীয়। তদ্ভিন্ন সতীপতি তথা আমি জানতে ইচ্ছা করি, এখন আমরা উপন্যাস আরম্ভ করতে পারি কি না। এইখানে আমাদের একটি অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাচ্ছি। পরস্পরের অজ্ঞাতে এবং গোপনে আমি ৪৩ পৃষ্ঠা আর সতীপতি ২৭ পৃষ্ঠা এগিয়েও পড়েছি ও পড়েছে। অবশ্য তার মধ্যে আমার প্রায় দেড় লাইন pen through করা (কাটা) আছে আর সতীপতি উক্ত ২৭ পৃষ্ঠায়, অনুমান আরো আধ লাইন বাড়াতে পারে।
এই সত্যবাদিতার জন্যে সাধুবাদান্তে আমরা সকলেই কালাচাঁদ খুড়োর দিকে চাইলুম। খুড়ো গড়্গড়ার ভূলুণ্ঠিত নলটি তুলে নিয়ে ছোট্টো একটি টান দিয়ে বললেন—“আগেকার কথা ছেড়ে দাও, তখন গল্প থাকতো ঠাকুমার আর দিদিমার মুখে, অধুনা নাতী নাতনীরা লায়েক হয়ে সে ভার হাতে নিয়েছে সুতরাং এখনকার হিসেবে যাঁর হাত থেকে তিন তিনটি গল্প বেরিয়ে ছাপার অক্ষরে ছড়িয়ে পড়েছে, তাঁর উপন্যাস আরম্ভ করবার আমি ত’ কোন বাধাই দেখি না। সকল সভ্য দেশেই “তিনের পর আর কথাটি চলে —এমন কি “ওয়ান, টু, থ্রি, (one, two, three) বলার পর fire (বন্দুক দাগা) পর্যন্ত বেপরোয়া চলো তিনের হাতুড়ি (hammer) পড়লে তালুক তড়াক করে তলিয়ে যায়,—বাধাবিঘ্ন মানে না তিন দিন পরে মা দুর্গাকেও জলসই করা চলে। পার্লিয়ামেন্টে third reading (তৃতীয় পাঠ) শেষ করে, কি না করা চলে! তিনটি শেষ করে এখন তোমরাও “ওঁ মেরে গেছ,—সৃজন, পালন, লয় সবই করতে পার, উপন্যাস, নবন্যাস, রমন্যাস, সর্বনাশ যেবা ইচ্ছা হয়! তবে গল্পের পর উপন্যাসই সাহিত্যসঙ্গত সোপান! কারণ গেঞ্জি আর গল্প টানলেই বাড়ে,—গল্পকে টেনে বাড়ালেই উপন্যাস,—এ ত’ পড়েই রয়েছে। বুঝলে না! ধরো, তুমি এই বলে একটি ছোট গল্প শেষ করেছ—“লতিকা সেই গভীর নিশীথ অন্ধকারে, লোক নয়নের অলক্ষ্যে—ধীরে ধীরে গঙ্গা বক্ষে ডুবিল! দেখিল কেবল তারকা—ডাকিল কেবল ঝিঝি বেশ, এতে কোন ভদ্রলোকের আপত্তি থাকতে পারে না কিন্তু বাবাজি, লতিকা কি আর ভাসতে পারে না? হাওড়ার বৃদ্ধবহুদর্শী পোলটিতে দাঁড়ালে দেখতে পাবে লোহা ভাসছে, বাহাদুরী-কাঠ ভাসছে, আর এক মোণ সাত সের ওজনের ক্ষীণাঙ্গী লতিকার ভেসে ওঠাটাই কি বড় কথা। এবং যেই লতিকার ভাসা, mind, মনে রেখো–এমনি উপন্যাসের আরম্ভ। তারপর স্রোত আছে, ঢেউ আছে, গঙ্গার দু’ধারি বাবুদের (মালঞ্চ নাই বললুম বাগান আছে,বজরা আছে তারপর পতিতা নিস্তারিণীর প্রাতঃস্নান আছে, যেখানে সুবিধে টেনে তোল না, কেউ বাধা দেবে না। এই সংস্রবে নিস্তারিণীর হৃদয়ের গোপন ও সুপ্ত দেবীভাব হঠাৎ দপ করে পবিত্র হোম-শিখার মত কিরণ ছাড়তে কতক্ষণ বাবাজি? দেখবে কেমন সময়োচিত সুরে বলে! নামও পাবে, দামও পাবো আমি অভয় দিচ্ছি লেগে যাও বাবাজি।”
সতীপতি তড়াক করে মাস্টারকে ডিঙিয়ে এসেই খুড়োর পায়ের ধুলো নিয়ে বললে—“মার দিয়া,—এই তো খুঁজছিলুম। এমন field (ক্ষেত্র) আর নেই—সোনা ফলবো পতিতাদের দুঃখে একটা গোপন ব্যথা—সহরের ভাবী-ভরসাদের প্রাণে গুমোট মেরে আছে,—এ আমি নিজেই জানি। উঃ, তাকে একবার vent (পথ) দিতে পারলে, আমি জোর করে বলতে –cent percent ফোয়ারা ছুটবে। পারবে ত’ বিলাস?”
ঘরজামাই বিলাসবন্ধুর চোখে মুখে হর্ষোচ্ছ্বাস ঠেল-মেরে এসেছিল, সে কথা কইতে পারলে, তার মুখ থেকে মাত্র বেরুলো—“কোন বীর হিয়া’
সতীপতি উত্তেজিত স্বরে বললে, “Enough! বস, আর বলতে হবে না। Research চাই, খেলো কাজ করা হবে না। আজ থেকে সন্ধ্যের বৈঠকে আমাদের আর আশা করবেন না। এই অমল অশ্রু-অঞ্জলি পূজার পূর্বেই দিতে হবে। খুড়োকে শত ধন্যবাদ for the timely hint (ইঙ্গিতের জন্য)।”
খুড়ো। তোমাদের উপন্যাস-এমপারার বলেছেন—“রজনী ধীরে।” তিনি অনায়াসেই বলতে পারতেন—“রজনী ছুটে” বা “রজনী তেড়ো” কিন্তু তা তিনি বলেননি, অতএব—“বাবাজি ধীরে!”
বিলাসবন্ধু। কিন্তু পশুদের প্রলোভনে পড়ে যারা “নিমেষের ভুলে’ বিপথে নীত হয়েছে, যাঁদের feeling (হৃদয়) আছে, তাদের জন্যে তাঁরা কি রয়ে-বোসে কাঁদবেন?
খুড়ো। শোনোইনা বন্ধু, বয়স তো আর মাইনে নয় বাবাজি, ওটায় আমার লোভও ছিল না, কিন্তু বছর বছর সে আপনিই বেড়ে বসেছে। তাতে লাভ হয়েছে কেবল “খুড়ো” খেতাব।
তোমরাও খুড়ো বল, চা খাওয়াও, পান দাও, আর গঙ্গড়ার দখল ত’ দিয়েই রেখেছ। সুতরাং পাপ বাড়াতে আর ইচ্ছে নেই বাবাজি, তাই বলি—সব জিনিসের অভিজ্ঞতাটা ল্যাবরেটরিতে গিয়ে অর্জন করে লায়েক হতে হয় না। উর্বশীর রূপ বা পারস্য সম্রাটের অন্দরমহল কি আর দেখে এসে বর্ণনা করতে হয়। লেখকদের ও-সব বিষয়ে ছাড়পত্র আছে তাঁরা যা লিখবেন— পাঠক তা পড়তে বাধ্যা পতিতাপর্বেও সেই অধিকার কায়েম রেখে, এই আড্ডায় বসেই কল্পনার কেরামতি যত পার চালাও, তোফা হবো অধিকার ছেড়ে পা বাড়ালে,—কে ঘুরচে, কে ফিরচে বুঝতেই পারবে না বাবাজি।