- বইয়ের নামঃ আমাদের সনডে-সভা
- লেখকের নামঃ কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আমাদের সনডে-সভা
কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
আমাদের আড্ডা ছিল বিডন-স্কয়ারে সতীপতিদের বৈঠকখানায়। আমরা সাতজন ছিলুম তার আনুষ্ঠানিক সভ্য বা দাসখৎ-লেখা সভ্য কেউ কেরানী, কেউ মাস্টার, কেউ গররাজি, কেউ সাহিত্যিক, কেউ স্বরাজী, কেউ ঘর-জামাই, কেউ বেকার। তাই রবিবারে রবিবারেই আমাদের ফুলবেঞ্চ বোসত সভ্য-সংখ্যা বাড়াবার নিয়ম ছিল না।
দৈবের ওপর কারুর দাপট চলে না।
সেটাও ছিল রবিবার, নরেন তখনো এসে পৌঁছয়নি। নরেনের রংটা ছিল একটু ময়লা—ঠিক কালো নয় কিন্তু এই অল্প অপরাধেই সে “কালাচাঁদ” নাম পেয়েছিল।
বেলা সাতটা হয় দেখে বীরেন বলে উঠল “কালাচাঁদ কোথায়?” বীরেনের সুরটা ছিল স্বভাবতই চড়া। প্রশ্নটা তার মুখ থেকে যেই বেরুনো, সঙ্গে সঙ্গেই “এই যে বাবাজি” বলেই, দীর্ঘ ছন্দের, নিকষকৃষ্ণ এক প্রৌঢ় মূর্তি, একদম পাপোস পেরিয়ে ঘরের মধ্যে হাজিরা রাত্রিকাল হলে, হয় আঁতকে উঠতুম, না হয় কাঠ মেরে যেতুম—দুটোর একটা হ’তই। তবু সকলে থতমত খেয়ে গেলুম।
বীরেন বললে—“কই আপনাকে ত’ আমরা ডাকি নি।”
আগন্তুক বেশ সপ্রতিভ ভাবে বললেন—‘সঙ্কোচের কোন কারণ নেই, তোমরা ত’ আর ভুল কর নি আর তা হলেই বা হয়েছে কি—আমি এটর্নিও নই, ডাক্তারও নই যে ফি” চার্জ করবা তবে ডাকটা কানে গেল বলেই এলুম। না এলেও ত’ অভদ্রতা হ’ত। হ’ত না বাবাজি!”
মাস্টার বললেন—“আমরা একজনকে ‘কালাচাঁদ’ বলি, তাঁরই খোঁজ করছিলুম।”
আগন্তুক বললেন—“ওঃ আপনারা বলেন! দাবীটে খুব জবর বটে। তা আপনারা সবই বলতে পারেনা আমি কিন্তু আজ ছ’মাস কলকেতায় বাসা নিয়েছি, চোখ বুজেও চলি না, কই এ পর্যন্ত আমার মত জন্ম-কালাচাঁদ ত’ নজরে পড়ে নি বাবাজি। এ ঘরটিই বড় রাস্তার ওপরেই, এখন থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত রাস্তার দিকে চেয়ে থেকে যদি আমার চেয়েও বড়িয়া কালাচাঁদ দেখতে পান, আমি একটান গুড়ুক পর্যন্ত না টেনেই, পেছু হটে বেরিয়ে যাব।”
আমাদের কালাচাঁদ (নরেন) তখন এসে গেছে। ব্যাঘাত ভাবটা কেটে গিয়ে সকলেই তখন আগন্তুকের কথা উপভোগ করছিলুম—বিশেষ করে তাঁর সাংঘাতিক প্রতিজ্ঞাটা।
নরেন অপাঙ্গে হাসি টেনে বললেন—“আপনার নাম তাহলে কালাচাঁদ?”
আগন্তুক সহজ ভাবেই বললেন—“জলকে জল বলে, সূর্যকে সূর্য বলে, রাতকে রাত বলে কারুকে বোঝাতে হয় না। হুঁকোকে যদি কেউ বাঁশ-গাছ ভাবেন, সে অপরাধ বোধ হুঁকোর নয়। বাবা আমার নামকরণে তাঁর নির্ভীকতার তথা সত্যপ্রিয়তার পূর্ণ পরিচয় রেখে গেছেন, তাই কেউ আমার নাম জিজ্ঞাসা করলে আমি অবাক হই।”
আমি বললুম—“মশাই আমাদের অপরাধ হয়েছে মাপ করবেন, আপনি দয়া করে বসুন। আপনি আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ, আপনাকে “কালাচাঁদ” বলে ডাকতে পারব না, অনুমতি হয় ত’ “কালাচাঁদ খুড়ো” বলবো।”
আগন্তুক বললেন—”বাবাজি’ বলে তার সূচনা তো পূর্বেই করে দিয়েছি।” তারপর তিনি ঠনঠনের চটি জোড়াটি খুলে আসরে আসন নিলেন। আমি তাওয়াদার আভাঙ্গা একটি কলকে গঙ্গড়ায় বসিয়ে নলটি তাঁকে এগিয়ে দিলুম। তারপর চা, পরেই পান, তার পরেই গুড়ুকের ঘন রিপিটিসন (ঢাল সাজ)।
এই ভাবেই স্বপাদ্য মাদুলীর মত বা দৈববাণীর মত আমরা তাঁকে লাভ করি। সেই পর্যন্ত তাঁকে পেলে আমাদের আড্ডা নিবে থাকতো অমন সর্বজ্ঞ সভ্য আমাদের মধ্যে কেউ ছিল না। যদিও তাঁর কাছ থেকে গুড়ুকের আওয়াজ ছাড়া অন্য আওয়াজ কমই পেতুম, কিন্তু যা দু’ একটি পেতুম তা দুর্লভ
আমাদের আড্ডা-অধিকারী সতীপতি আর ঘর-জামাই বিলাসবন্ধু, এই সদস্যদ্বয় ছিলেন ডাঁসা সাহিত্যিক অর্থাৎ উভয়েই তিনটি করে ছোট গল্প লেখা শেষ করেছিলেন। বলাই বাহুল্য—সেই গল্পগুলি নিয়ে তিপ্পান্নখানা মাসিকের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। শেষে “সাহিত্য-শাল্মলী” পত্রিকার সৌভাগ্যবান সম্পাদককে সতীপতি বলেন—“দেখবেন কেউ যেন ওর ওপর কলম চালিয়ে, মাটি করে না দেয়।” তাতে সম্পাদক বলেন—“আমরা পূর্বে পূর্বে অনেক চেষ্টা করে দেখেছি—সোনা মাটি হয় না, তা ছাড়া আমাদের সে সময় থাকলে তো! পুজো এসে গেল, নিজের উপন্যাস তিনখানা না বার করতে পারলে, এক বছর এখন গুদোম ভাড়া গোনো আর উয়ের পেট পোরাও উঃ, তেরো দিনের মধ্যে সতেরো চ্যাপটার টেনে দিতে হবে।”
জামাই বললেন—“কিন্তু বানানগুলো”।–
তাকে আর এগুতে না দিয়েই সম্পাদক শুরু করে দিলেন—“সে দুর্ভাবনা কিছুমাত্র রাখবেন,—আমরা ভদ্রলোকের মান রাখতে জানি ঐ জন্যেই বেহার থেকে কম্পোজিটার আনিয়েছি, যেমনটি দেখবে সেইটি হুবহু বসিয়ে যাবো সাধ্য কি যে লেখকদের বানানে হাত পড়ে। সে। বেয়াদবির জড় মেরে রেখেছি মশাই, তা-নাতো ভদ্র-সন্তানেরা লিখবেন কেন?”
সম্পাদককে প্রস্থানোদ্যত দেখে সতীপতি ব্যগ্রভাবে বলে উঠলো—“দেখুন, এক জায়গায় আছে—“তখন রৌদ্রে পৃথিবী প্লাবিত হচ্ছে, দিগদিগন্ত ভাসছে কি হাসছে’—”
সম্পাদক তাড়াতাড়ি বললেন—“একদম নতুন স্টাইল, নতুন আইডিয়া, ভাষার উন্নতির সঙ্গে ভাব প্রকাশ কেমন সহজ হয়ে আসছে, অন্ধেরও লক্ষ্য এড়ায় না! এই তো চাই, verily in the neighbourhood of Art (একদম আর্টের পাড়ায় পৌঁছে গেছে) ও আর দেখতে হবে না”— বলতে বলতে দ্রুত প্রস্থান করলেন।