সবার কাছ থেকেই বিদায় নিলাম। লতিফার কাছ থেকে বিদায় নিতে পারলাম না। সে যখন সামনে এসে দাঁড়াল তখন চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারলাম না।
লতিফা বলল, চলে যাচ্ছেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
কেন, আমরা কি কোনো দোষ করেছি?
ছি ছিং-দোষ করবে কেন?
আচ্ছা, যাওয়ার আগে এই ধাঁধাটা ভাঙায়ে দিয়ে যান-বলেন দেখি–
ছাই ছাড়া শোয় না;
লাথি ছাড়া ওঠে না। এই জিনিস কি?
জানি না লতিফা।
এত সহজ জিনিস পারলেন না। এটা হল কুকুর। আচ্ছা যান। দোষঘাট হলে ক্ষমা করে দিয়েন।
আমি আড়তে চলে আসলাম। রাত আটটার দিকে মোক্তার সাহেব লোক পাঠিয়ে আমাকে ডাকিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি শোকার ঘরে চেয়ারে বসে ছিলেন। আমাকে সেইখানে নিয়ে যাওয়া হল। আমি খুবই অবাক হলাম। একটু ভয়ভয়ও করতে লাগল। তাকিয়ে দেখি মোক্তার সাহেবের স্ত্রী খাটে বসে আছেন। নিঃশব্দে কাঁদছেন। আমি কিছুই বুঝলাম না। বুক ধড়ফড় করতে লাগল। না জানি কী হয়েছে।
মোক্তার সাহেব বললেন, তোমাকে আমি পুত্রের মতো স্নেহ করেছি। তার বদলে তুমি এই করলে? দুধ দিয়ে কালসাণ পোষার কথা শুধু শুনেছি। আজ নিজের চোখে দেখলাম।
আমি মোক্তার সাহেবের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললাম, মা, আমি কিছুই বুঝতেছি না।
মোক্তার সাহেব চাপা স্বরে বললেন, বোকা সাজার দরকার নাই! বোকা সাজবা না। তুমি যা করেছ তা তুমি ভালোই জান। তুমি পথের কুকুরেরও অধম।
আমি বললাম, আমার কী অপরাধ দয়া করে বলেন।
মোক্তার সাহেব রাগে কাঁপতে-কাঁপতে বললেন, মেথরপট্টিতে যে শুয়োর থাকে তুই তার চেয়েও অধম—তুই নর্দমার ময়লা। বলতে-বলতে তিনিও কোঁদে ফেললেন।
মোক্তার সাহেবের স্ত্রী বললেন, লতিফা সবই আমাদের বলেছে–কিছুই লুকায় নাই। এখন এই অপমান এই লজ্জার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় লতিফার সঙ্গে তোমার বিবাহ দেওয়া। তুমি তাতে রাজি আছ, না মেয়ের সর্বনাশ করে পালানোই তোমার ইচ্ছা?
আমি বললাম, মা, আপনি কী বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারতেছি না। লতিফা কী বলেছে আমি জানি না। তবে আপনারা যা বলবেন-আমি তা-ই করব। আল্লাহপাক উপরে আছেন। তিনি সব জানেন, আমি কোনো অন্যায় করি নাই মা।
মোক্তার সাহেব চিৎকার করে বললেন, চুপ থাক, শুয়োরের বাচ্চা। চুপ থাক।
সেই রাতেই কাজী ডাকিয়ে বিয়ে পড়ানো হল। বাসর রাতে লতিফা বলল, আমি একটা অন্যায় করেছি।–আপনার সাথে যেন বিবাহ হয় এই জন্য বাবা-মাকে মিথ্যা বলেছি—আমার পেটে সন্তান আছে। বিরাট অপরাধ করেছি, আপনার কাছে ক্ষমা চাই।
আমি বললাম, লতিফা, আমি তোমার অপরাধ ক্ষমা করলাম! তুমি আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা চাও।
আপনি ক্ষমা করলেই আল্লাহ ক্ষমা করবেন। তা ছাড়া আমি তেমন বড় অপরাধ তো করি নাই! সামান্য মিথ্যা বলেছি। আপনাকে বিবাহ করার জন্য অনেক বড় অপরাধ করার জন্যও আমি তৈরি ছিলাম। আচ্ছা এখন বলেন এই ধাঁধাটির মানে কি–
আমার একটা পাখি আছে
যা দেই সে খায়।
কিছুতেই মরে না পাখি
জলে মারা যায়।
বুঝলেন ভাইসাহেব, আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল। এই আনন্দের কোনো সীমা নাই! আমার মতো নাদান মানুষের জন্য আল্লাহপাক এত আনন্দ রেখে দিয়েছেন। আমি কল্পনাও করি নাই! আমি কত বার যে বললাম, আল্লাহপাক, আমি তোমার নেয়ামত স্বীকার করি। আমি তোমার নেয়ামত স্বীকার করি।
বিয়ের পর আমি শ্বশুরবাড়িতেই থেকে গেলাম। আমার এবং লতিফার বড় দুঃখের সময় কাটতে লাগল। শ্বশুরবাড়ির কেউ আমাদের দেখতে পারে না। খুবই খারাপ ব্যবহার করে। আমার শাশুড়ি দিন-রাত লতিফাকে অভিশাপ দেন-মর, মর, তুই মর।
আমার শ্বশুরসাহেব একদিন আমাকে ডেকে বললেন, সকালবেলায় তুমি আমার সামনে আসবা না। সকালবেলায় তোমার মুখ দেখলে আমার দিন খারাপ যায়।
শ্বশুরবাড়ির কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে না। তারা একসঙ্গে খেতে বসে। সেখানে আমার যাওয়া নিষেধ। সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হলে লতিফা থালায় করে আমার জন্য ভাত নিয়ে আসে। সেই ভাত আমার গলা দিয়ে নামতে চায় না।
লতিফা রোজ বলে, চল, অন্য কোথাও যাই গিয়া।
আমি চুপ করে থাকি। কই যাব বলেন? আমার কি যাওয়ার জায়গা আছে? যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। লতিফা খুব কান্নাকাটি করে।
একদিন খুব অপমানের মধ্যে পড়লাম। আমার শ্বশুরসাহেবের পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক হাজার টাকা চুরি গেছে। তিনি আমারে ডেকে নিয়ে বললেন, এই যে দাড়িওয়ালা, তুমি কি আমার টাকা নিছ?
আমার চোখে পানি এসে গেল। এ কী অপমানের কথা! আমি দরিদ্র। আমার যাওয়ার জায়গা নাই-সবই সত্য, কিন্তু তাই বলে আমি কি চোর? ছিঃ ছিঃ।
শ্বশুরসাহেব বললেন, কথা বল না কেন? আমি বললাম, আমারে অপমান কইরেন না। যত ছোটই হই, আমি আপনার কন্যার স্বামী।
শ্বশুরসাহেব বললেন, চুপ। চোর আবার ধর্মের কথা বলে! লতিফা সেইদিন থেকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিল। সে বলল-এই বাড়ির তাত সে মুখে দিবে না।
আমার শাশুড়ি বললেন, ঢং করিস না। এই বাড়ির ভাত ছাড়া তুই ভাত পাইবি কই?
দুই দিন দুই রাত গেল, লতিফা পানি ছাড়া কিছুই মুখে দেয় না। আমারে বলে, তুমি আমারে অন্য কোথাও নিয়া চল। দরকার হইলে গাছতলায় নিয়া চল। এই বাড়ির ভাত আমি মুখে দিব না।
আমি মহা বিপদে পড়লাম।
হাত উঠায়ে বললাম।–হেমাবৃন্দ। হে পাক পরোয়ারদিগার—তুমি ছাড়া আমি কার কাছে যাব? আমার দুঃখের কথা কারে বলব? কে আছে আমার? তুমি আমারে বিপদ থাইক্যা বাঁচাও।