কিন্তু শয়তান যে পুরুষ তা আপনি জানেন?
জানি।
আপনে ভুল জানেন। শয়তান পুরুষও না স্ত্রীও না! শয়তান আলাদা এক জাত।
আমি মেয়েটার বুদ্ধি দেখে খুবই অবাক হই। এই রকম সে প্রায়ই করে। একদিনের কথা। ছুটির দিন। দুপুর বেলা। বাংলাঘরে আমি ঘুমাচ্ছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। অবাক হয়ে দেখি, লতিফা আমার ঘরে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। লতিফা বলল, আপনেরে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করতে আসছি। আচ্ছা বলেন তো–
হেন কোন গাছ আছে। এ-ধরায়
স্থলে জলে কভু তাহা নাহি জন্মায়।
আমি ধাঁধার জবাব না-দিয়ে বললাম, তুমি কখন আসছ?
লতিফা বলল, অনেকক্ষণ হইছে আসছি। আপনে ঘুমাইতেছিলেন, আপনারে জাগাই নাই! এখন বলেন-ধাঁধার উত্তর দেন,
হেন কোন গাছ আছে। এ-ধরায়
স্থলে জলে কভু তাহা নাহি জন্মায়।
আমি বললাম, এইটার উত্তর জানা নাই।
উত্তর খুব সোজা। উত্তর হইল-পরগাছা। আচ্ছা আরেকটা ধরি বলেন দেখি–
পাকলে খেতে চায় না, কাঁচা খেতে চায়
এ কেমন ফল বল তো আমায়?
মেয়েটার কাণ্ডকারখানায় আমার ভয়ভয় লাগতে লাগল। কেন সে এই রকম করে? কেন বারবার আমার ঘরে আসে? লোকের চোখে পড়লে নানান কথা। রটবে। মেয়ে যত সুন্দর তারে নিয়া রটনাও তত বেশি।
লতিফা আমার বিছানায় বসন্তে-বসতে বলল, কই বলেন এটার উত্তর কি–
পাকলে খেতে চায় না, কাঁচা খেতে চায়
এ কেমন ফল বল তো আমায়?
বলতে পারলেন না! এটা হল- শশা! পাকা শশা কেউ খায় না। সবাই কাঁচা শশা চায়। আচ্ছা আপনার বুদ্ধি এত কম কেন? একটাও পারেন না। আপনি একটা ধাঁধা ধরেন। আমি সঙ্গে-সঙ্গে বলে দেব।
আমি ধাঁধা জানি না লতিফা।
আপনি কী জানেন? শুধু আল্লাহ-আল্লাহ করতে জানেন, আর কিছু জানেন?
লতিফা, তুমি এখন ঘরে যাও।
ঘরেই তো আছি। এইটা ঘর না? এইটা কি বাহির?
যুখন-তখন তুমি আমার ঘরে আসা- টা ঠিক না।
ঠিক না কেন? আপনি কি বাঘ না ভালুক?
আমি চুপ করে রইলাম। আধা-পাগল ই মেয়েকে আমি কী বলব? ই মেয়ে কদিন নিজে বিপদে পড়বে, আমাকেও বিপদে ফেলবে। লতিফা বলল, আমি যে মাঝুেমুলার খানে আসি—সেইটা আপনার ভালো লাগে না-ঠিক না?
হ্যাঁ, ঠিক।
ভালো লাগে না কেন?
নানান জনে নানান কথা বলতে পারে।
কী কথা বলতে পারে? আপনার সঙ্গে আমার ভালবাসা হয়ে গেছে? চুপ করে আছেন কেন, বলেন।
তুমি এখন যাও লতিফা।
আচ্ছা যাই। কিন্তু আমি আবার আসব। রাত-দুপুরে আসব। তখন দেখবেন-কী বিপদ!
কেন এই রকম করতেছ লতিফা?
লতিফা উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বলল, যে ভয় পায় তাকে ভয় দেখাতে আমার ভালো লাগে। ইজন্যে এএরকম করি। আচ্ছা মৌলানা সাহেব, যাই। আসসালামু আলায়কুম। ওয়া রহমাতুল্লাহে ওয়া বরকাতুহু। হি-হি-হি।
ভাই, আপনার কাছে সত্য কথা গোপন করব না। সত্য গোপন করা বিরাট অন্যায়। আল্লাহুপাক সত্য গোপনকারীকে পছন্দ করেন না। চাকরি পাওয়ার পরেও আমি মোক্তার সাহেবের বাড়িতে থেকে গেলাম শুধু লতিফার জন্য। তারে দেখার জন্য মনটা ছটফট করত। মনে-মনে অপেক্ষা করতাম কোন সময় তারে কনজার হলেও দেখব। তার পায়ের শব্দ শুনলেও বুক ধড়ফড় করত। রাত্রে ভালো ঘুম হত না। শুধু লতিফার কথা ভাবতাম! বলতে খুব শরম লাগছে ভাই-সাব, তবু বলি-লতিফার চুলের কাটা কাঁটা আমি সবসময় আমার সঙ্গে রাখতাম। আমার কাছে মনে হত— ইটা চুলের কাঁটা না, সাত রাজার ধন। আমি আল্লাহপাকের দরবারে কান্নাকাটি কুরতাম। বলতাম।–হে পরোয়ারদিগার, হে গাফুরুর রহিম, তুমি আমাকে –কি বিপদে ফেললা। তুমি আমারে উদ্ধার করা।
আল্লাহপাক আমাকে উদ্ধার করলেন। লতিফার বিবাহের প্রস্তাব আসল। ছেলে এম.বি.বি.এস. ডাক্তার। বাড়ি গৌরীপুর। ভালো বংশ। খান্দানি পরিবার। ছেলে নিজে সে মেয়ে দেখে গেল। মেয়ে তার খুব পছন্দ হল। পছন্দ না-হওয়ার কোনো কারণ নাই। লতিফার মতো রূপবতী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। ছেলেও দেখতে শুনতে ভালো। শুধু গায়ের রঙটা একটু ময়লা। কথায় বার্তায়ও ছেলে অতি ভদ্র। বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেল। বারই শ্রাবণ। শুক্রবার দিবাগত রাত্রে বিবাহ পড়ানো হবে।
আমার মনটা বড়ই খারাপ হয়ে গেল। আমি জানি, ই মেয়ের সঙ্গে আমার বিবাহের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কোথায় সে আর কোথায় আমি। চাকরীশ্রেণীর আশ্ৰিত কজন মানুষ। জমিজমা নাই, আত্মীয়স্বজন নাই, সহায়-সম্বল নাই। তার জন্য আমি কোনোদিন আফসোস করি নাই। আল্লাহপাক যাকে যা দেন তাই নিয়াই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আমিও ছিলাম। কিন্তু যে-দিন লতিফার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেল সে-দিন কী যে কষ্ট লাগল বলে আপনাকে বুঝাতে পারব না! সারা রাত শহরের পথে-পথে ঘূরলাম। জীবনে কোনোদিন নামাজ কাজ করি নাই—এই প্রথম এশার নামাজ কাজ করলাম। ফজরের নামাজ কাজ করলাম। এত দিন পরে বলতে লজ্জা লাগছে–আমার প্ৰায় মাথা-খারাপের মতো হয়ে গিয়েছিল। তোরকেলা মোক্তার সাহেবের বাসায় গেলাম! সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এইখানে আর থাকব না। বাজারে চালের আড়তে থাকব। মোক্তার সাহেবের স্ত্রী বললেন, এখন যাবে কেন বাবা? মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কত কাজকর্ম। কাজকর্ম শেষ করে তারপর যাও।
আমি মিথ্যা কথা বলি না। প্রথম মিথ্যা বললাম। আমি বললাম, মা, সিদ্দিকুর রহমান সাহেব আমাকে আজই দোকানে গিয়ে উঠতে বলেছেন-উনি আমার মনিব-অন্নদাতা। ওনার কথা না রাখলে অন্যায় হবে। বিয়ের সময় আমি চলে আসব। কাজকর্মের কোনো অসুবিধা হবে না, মা।