মমতাজ সাহেব বললেন, তোমাকে চাকরি দেওয়া সম্ভব না। নেও, এই বিশটা টাকা রাখ। অন্য কারো কাছে যাও। মসজিদে খোঁজটোজ নাও–ইমামতি পাও কি না দেখ।
আমি টাকাটা নিলাম। তারপর বললাম, ভিক্ষা নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। ঘরের কোনো কাজকর্ম থাকে বলেন, করে দেই।
তিনি অবাক হয়ে বললেন, কী কাজ করতে চাও?
যা বলবেন করব। বাগানের ঘাসগুলো তুলে দেই?
আচ্ছা দাও।
আমি বাগান পরিষ্কার করে দিলাম। গাছগুলোতে পানি দিলাম। দু-এক জায়গায় মাটি কুপিয়ে দিলাম। সন্ধ্যাবেলা কাজ শেষ করে বললাম, জনাব যাই। আপনার অনেক মেহেরবানী। আল্লাহ্ পাকের দরবারে আমি আপনার জন্য দোয়া করি।
মমতাজ সাহেব বললেন, এখন যাবে কোথায়?
ইস্টিশনে। রাত্রে নেত্রকোণা ইস্টিশনে আমি ঘুমাই।
এক কাজ করা। রাতটা এইখানেই থাক। তারপর দেখি।
আমি থেকে গেলাম।
এক দিন দুই দিন তিনদিন চলে গেল। উনি কিছু বলেন না। আমিও কিছু বলি না। বাংলাঘরের এক কোণায় থাকি। বাগান দেখাশোনা করি। চাকরির সন্ধান করি। ছোট শহর, আমার কোনো চিনা-পরিচয়ও নাই। কে দেবে চাকরি? ঘুরাঘুরি সারা হয়। মোক্তার সাহেবের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হয়। আমি বড়ই শরমিন্দা বোধ করি। উনিও এমন ভাব করেন যেন আমাকে চেনেন না। মাসখানেক এইভাবে চলে গেল। আমি মোটামুটি তাঁদের পরিবারের একজন হয়ে গেলাম। মোক্তার সাহেবের স্ত্রীকে মা ডাকি। ভেতরের বাড়িতে খেতে যাই। তাঁদের কোনো—একটা উপকার করার সুযোগ পেলে প্ৰাণপণে করার চেষ্টা করি। বাজার করে দেই। কাল থেকে পানি তুলে দেই।
মোক্তার সাহেবের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে বিধবা হয়ে বাবার সঙ্গে আছে। তার দুই বাচ্চাকে আমি আমপারা পড়াই। বাজার-সদাই করে দেই। টিপকাল থেকে রোজ ছয়সাত বালতি পানি তুলে দেই। মোক্তার সাহেবের কাছে যখন মক্কেলরা আসে, তিনি ঘনঘন তামাক খান। সেই তামাকও আমি সেজে দেই। চাকরবাকারের কাজ। আমি আনন্দের সঙ্গেই করি। মাঝে-মাঝে মনটা খুবই খারাপ হয়। দরজা বন্ধ করে একমনে। কোরান শরিফ পড়ে। আল্লাহপাকরে ডেকে বলি-হে আল্লাহ্, আমার একটা উপায় করে দাও। কতদিন আর মানুষের বাড়িতে অন্নদাস হয়ে থাকব?
আল্লাহপাক মুখ তুলে তাকালেন। সিদ্দিকুর রহমান সাহেব বলে এক ব্যবসায়ী বলতে গেলে সোধে আমাকে চাকরি দিয়ে দিলেন। চালের আড়তে হিসাবপত্র রাখা। মাসিক বেতন পাঁচ শ টাকা।
মোক্তার সাহেবকে সালাম করে খবরটা দিলাম। উনি খুবই খুশি হলেন। বললেন, তোমাকে অনেকদিন ধরে দেখতেছি। তুমি সৎ স্বভাবের মানুষ! কাজ করা, তোমার আয়-উন্নতি হবে। আর রাতে তুমি আমার বাড়িতেই থাক। তোমার কোনো অসুবিধা নাই। খাওয়াদাওয়াও এইখানেই করবে। তোমাকে আমি ঘরের ছেলের মতোই দেখি।
আনন্দে মনটা ভরে গেল। চোখে পানি এসে গেল। আমি মোক্তার সাহেবের কথামতো তাঁর বাড়িতেই থাকতে লাগলাম। ইচ্ছা করলে চালের আড়তে থাকতে পারতাম। মন টানল না। তা ছাড়া মোক্তার সাহেবের বাগানটা নিজের হাতে তৈরি করেছি। দিনের মধ্যে কিছুটা সময় বাগানে না থাকলে খুব অস্থির-অস্থির লাগে।
একমাস চাকরির পর প্রথম বেতন পেলাম! পাঁচ শ টাকার বদলে সিদ্দিকুর রহমান সাহেব ছ শ টাকা দিয়ে বললেন, তোমার কাজকর্ম ভালো। এইভাবে কাজকর্ম করলে বেতন আরো বাড়িয়ে দিব।
আমার মনে বড় আনন্দ হল। আমি তখন একটা কাজ করলাম। পাগলামিও বলতে পারেন! বেতনের সব টাকা খরচ করে মোক্তার সাহেবের স্ত্রী এবং তাঁর তিন মেয়ের জন্য চারটা শাড়ি কিনে ফেললাম। টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি। মোক্তার সাহেবের জন্য একটা খদ্দরের চাদর।
মোক্তার সাহেবের স্ত্রী বললেন, তোমার কি মাথাটা খারাপ? এইটা তুমি কী করলা? বেতনের প্রথম টাকা-তুমি তোমার আত্মীয়স্বজনের জন্য জিনিস কিনবা, বাড়িতে টাকা পাঠাইবা।
আমি বললাম, মা, আমার আত্মীয়স্বজন কেউ নাই। আপনারাই আমার আত্মীয়স্বজন।
তিনি খুবই অবাক হয়ে বললেন, কই, কোনোদিন তো কিছু বল নাই!
আপনি জিজ্ঞেস করেন নাই–এই জন্য বলি নাই। আমার বাবা-মা খুব ছোটবেলায় মারা গেছেন। আমি মানুষ হয়েছি। এতিমখানায়। এতিমখানা থেকেই উলা পাস করেছি।
উনি আমার কথায় মনে খুব কষ্ট পেলেন। উনার মনটা ছিল পানির মতো। সবসময় টলটল করে। উনি বললেন, কিছু মনে নিও না। আমার আগেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। তুমি আমারে মা ডাক আর আমি তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না-এইটা খুবই অন্যায় কথা। আমার খুব অন্যায় হইছে।
তিনি তাঁর তিন মেয়েরে ডেকে বললেন, তোমরা এরে আইজ থাইক্যা নিজের ভাইয়ের মতো দেখবা। মনে করুবা তোমরার এক ভাই। তার সামনে পর্দা করার দরকার নাই।
এর মধ্যে একটা বিশেষ জরুরি কথা বলতে ভুলে গেছি।–মোক্তার সাহেবের ছোটো মেয়ে লতিফার কথা। এই মেয়েটা পরীর মতো সুন্দর। একটু পাগল ধরনের নিজের মনে কথা বলে। নিজের মনে হাসে যখন—তখন বাংলা-ঘরে চলে আসে। আমার সঙ্গে দুই-একটা টুকটাক কথাও বলে। অদ্ভুত সব কথা! একদিন এসে বলল, এই যে মৌলানা সাব, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে আসছি। আচ্ছা বলেন তো—শয়তান পুরুষ না মেয়েছেলে?
আমি বললাম, শয়তান পুরুষ।
লতিফা বলল, আল্লা মেয়ে-শয়তান তৈরি করেন নাই কেন?
আমি বললাম, তা তো জানি না। আল্লাহপাকের ইচ্ছার খবর কেমনে জানব? আমি অতি তুচ্ছ মানুষ।