আমি খুব, যে ভরসা পাচ্ছি, তা নয়। চৌকি এনে ঘুমুতে পারলে হত। মসজিদের ভেতর চৌকি পেতে শোয়া-ভাবাই যায় না।
সফিকের হচ্ছে ইচ্ছা!ঘুম! শোয়ামাত্ৰ নাক ডাকতে শুরু করেছে। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মসজিদের ভেতর আগরবাতির গন্ধ। যে-গন্ধ সবসময় মৃত্যুকে মনে করিয়ে দেয়। সব মিলিয়ে গা ছমছমানো ব্যাপার।
আমি ইমাম সাহেবকে বললাম, আপনি চলে যান, আপনি এখানে বসে আছেন কেন? আপনার স্ত্রী একা। তাঁর শরীরও ভালো না।
ইমাম সাহেব বললেন, আমি মসজিদেই থাকব। এবাদত-বন্দেগি করব। ফজরের নামাজ শেষ করে বাসায় গিয়ে ঘুমুব।
কেন?
লতিফা এখন আমাকে দেখলে উন্মাদের মতো হয়ে যাবে। মেঝেতে মাথা ঠুকবে।
কেন?
ওর দোষ নাই কিছু। সঙ্গে জিন আছে-কফিল। এই জিনই সবকিছু করায়।
আমি চুপ করে রইলাম! ইমাম সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, এমনিতে তেমন উপদ্রব করে না। সন্তানসম্ভবা হলেই কফিল ভয়ংকর যন্ত্রণা করে। বাচ্চাটা মেরে না ফেলা পর্যন্ত থামে না। দুইটা বাচ্চা মেরেছে—এইটাও মারবে।
আপনার স্ত্রী কি সন্তানসম্ভব?
জ্বি।
আপনি কি নিশ্চিত যে পুরো ব্যাপারটা জিন করছে, অন্য কিছু না?
জ্বি, নিশ্চিত। জিনের সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যে কথা হয়।
অবিশ্বাস্য সব কথাবার্তা বলছেন আপনি!
অবিশ্বাসের কিছু নাই। একদিনের ঘটনা বলি-তাহলে বুঝবেন। ভাদ্র মাস। গরম। একটা ভেজা গামছা শরীরে জড়ায়ে এশার নামাজে দাঁড় হয়েছি। মসজিদে একা। আমি ছাড়া আর কেউ নাই। হঠাৎ দপ করে হারিকোনটা নিভে গেল। চমকে উঠলাম। তারপর শুনি মসজিদের পিছনের দরজার কাছে ধূপ-ধূপ শব্দ। খুব ভয় লাগল। নামাজ ছেড়ে উঠতে পারি না! নামাজে মনও দিতে পারি না। কিছুক্ষণ পরপর পিছনের দরজায় ধুপ ধুপ শব্দ। যেন কেউ কিছু একটা এনে ফেলছে। সেজদায় যাবার সময় কফিলের গলা শুনলাম—টেনে- টেনে বলল, তোরে আইজ পুড়াইয়া মারব। তোরে আইজ পুড়াইয়া মারব। তারপর ধাপ করে আগুন জ্বলে উঠল। দাউদাউ আগুন। নামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। দেখি দরজার কাছে গাদা করা শুকনা লাকড়ি। আগুন জ্বলছে। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম— বাঁচাও, বাঁচাও আমার চিৎকার শুনে লতিফ পানির বালতি হাতে ছুটে আসল। পানি দিয়ে আগুন নিভায়ে আমারে মসজিদ থেকে টেনে বার করল! আমার স্ত্রীর কারণে সেই যাত্রা বেঁচে গেলাম। লতিফা সময়মতো না আসলে মারা পড়তাম।
জিন মসজিদের ভেতরে ঢুকল না কেন?
খারাপ ধরনের জীন। আল্লাহর ঘরে এরা ঢুকতে পারে না। আমি এই জন্যই বেশির ভাগ সময় মসজিদে থাকি। মসজিদে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে পারি। ঘরে পারি না।
কফিল আপনাকে খুন করতে চায়?
তাও ঠিক না–একবারই চেয়েছিল। তারপর আর চায় নাই।
খুন করতে চেয়েছিল কেন?
ইমাম সাহেব চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, আপনার যদি আপত্তি না থাকে পুরো ঘটনাটা বলুন। আপত্তি থাকলে বলার দরকার নেই।
না, আপত্তির কী আছে? আপত্তির কিছু নাই। আমি লতিকার অবস্থা একটু দেখে যান, দেখে আসি।
যান, দেখে আসুন।
ইমাম সাহেব চলে গেলেন। আমি ভয়ে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগিলাম। ভূত, প্ৰেত, জিন, পরীকখনো বিশ্বাস করি নি- এখনো করছি না, তবু আতঙ্কে আধমরা হয়ে গেছি। সফিক জেগে থাকলে খানিকটা ভরসা পাওয়া যেত। সে ঘুমুচ্ছে মড়ার মতো। একেই বলে পরিবেশ। ইমাম সাহেব দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন। বিরস গলায় বললেন, ভালোই আছে, তবে ভীষণ চিৎকার করছে।
তালাবন্ধ করে রেখেছেন?
জ্বি-না। তালাবন্ধ করে তাকে রাখা সম্ভব না। কফিল ওর সঙ্গে থাকে-কাজেই ওর গায়ের জোর থাকে অসম্ভব। না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না।
ইমাম সাহেব মন-খারাপ করে বসে রইলেন। আমি কালাম, গল্পটা শুরু করুন ভাই।
কথা পুরোপুরি শেষ করতে পারলেন না। মসজিদে প্রচণ্ড শব্দে টিল পড়তে লাগল। ধূপধুপ শব্দ। সেই সঙ্গে মনে হচ্ছে কয়েকজন মানুষ যেন চারদিকে ছোটাছুটি করছে। আমি আতঙ্কিত গলায় বললাম, কী ব্যাপার?
ইমাম সাহেব বললেন, কিছু না। কফিল চায় না। আমি কিছু বলি।
থাক ভাই, বাদ দিন। গল্প বলার দরকার নেই।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই টিল। ছোঁড়া বন্ধ হবে। ভয়ের কিছুই নাই।
সত্যি-সত্যি বন্ধ হল। বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগল। ইমাম সাহেব গল্প শুরু করলেন। আমি তাঁর গল্পটাই বলছি। তাঁর ভাষাতে। তবে আঞ্চলিকতাটা সামান্য বাদ গল্পের মাঝখানেও একবার তুমুল ঢিল ছোঁড়া হল। ইমাম সাহেব একমনে আয়াতুল কুরসি পড়লেন। আমার জীবনে সে এক ভয়াবহ রাত।
.
২.
নেত্রকোণা শহরের বিশিষ্ট মোক্তার মমতাজউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে তখন আমি থাকি। ওনার সঙ্গে আমার কোনো আত্মীয়সম্পর্ক নাই। লোকমুখে শুনেছিলাম–বিশিষ্ট ভদ্রলোক। কেউ কোনো বিপদে পড়ে। তাঁর কাছে গেলে তিনি যথাসাধ্য করেন। আমার তখন মহাবিপদ। এক বেলা খাই তো এক বেলা উপোস দেই। সাহসে ভর করে তাঁর কাছে গেলাম চাকরির জন্য। উনি বললেন, চাকরি যে দিব, পড়াশোনা কী জানো?
আমি বললাম, উলা পাস করছি।
উনি বিরক্ত হয়ে বললেন, মাদ্রাসা পাস-করা লোক, তোমারে আমি কী চাকরি দিব! আই.এ.বি.এ. পাস থাকলে কথা ছিল। চেষ্টাচরিত্র করে দেখতাম। চেষ্টা করারও তো কিছু নাই।
আমি চুপ করে রইলাম! মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বড় আশা ছিল কিছু হবে। একটা পয়সা সঙ্গে নাই। উপোস দিচ্ছি। রাতে নেত্রকোণা স্টেশনে ঘুমাই।