সফিক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কেমন আছেন?
ইমাম সাহেবের স্ত্রী সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, ভালো নাই। আমার সঙ্গে একটা জিন থাকে। জ্বিনটার নাম কফিল। কফিল আমারে খুব ত্যক্ত করে।
সফিক হতভম্ব হয়ে বলল, আপনি কী বললেন, বুঝলাম না।
মেয়েটি যন্ত্রের মতো বলল, আমার সঙ্গে একটা জিন থাকে। জ্বিনটার নাম কফিল। কফিল আমারে বড় যন্ত্রণা করে।
সফিক অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। আমি নিজেও বিস্মিত। ব্যাপার কী কিছু বুঝতে পারছি না। ইমাম সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন- লতিফা, তুমি একটু ভিতরে যাও।
ভদ্রমহিলা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, ক্যান? ভিতরে ক্যান? থাকলে কী অসুবিধা?
ওনাদের সঙ্গে কিছু কথা বলব! তুমি না থাকলে ভালো হয়। সব কথা মেয়েছেলেদের শোনা উচিত না।
লতিফা তীব্র চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল। খাওয়া বন্ধ করে আমরা হাত গুটিয়ে বসে রইলাম। এ কী সমস্যা!
লতিফা মেয়েটি রূপবতী। শুধু রূপবতী নয়, চোখে পড়ার মতো রূপবতী। হালকাপাতলা শরীর। ধবধবে ফরসা গায়ের রঙ। লম্বাটে স্নিগ্ধ মুখ। বয়সও খুব কম মনে হচ্ছে। দেখাচ্ছে আঠার-উনিশ বছরের তরুণীর মতো। এত কম বয়স তার নিশ্চয় নয়। যার স্বামীর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি তার বয়স আঠার-উনিশ হতে পারে না। আরো একটি লক্ষ করার মতো ব্যাপার হল-মেয়েটি সাজগোজ করেছে। চুল বেঁধেছে, চোখে কাজল দিয়েছে-কপালে। লাল রঙের টিপ। গ্রামের মেয়েরা কপালে টিপ দেয় বলেও জানতাম ন।
ইমাম সাহেব। আবার বললেন, লতিফ, ভিতরে যাও।
মেয়েটি উঠে চলে গেল।
ইমাম সাহেব গলার স্বর নিচু করে বললেন, লতিফার মাথা পুরাপুরি ঠিক না। ওরা দুটো সন্তান নষ্ট হয়েছে। তারপর থেকে এ-রকম। তার ব্যবহারে আপনারা কিছু মনে করবেন না। আমি তার হয়ে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই। কিছু মনে করবেন। না।–আল্লাহর দোহাই।
আমি বললাম, কিছুই মনে করি নি। তা ছাড়া মনে করার মতো কিছু তো উনি করেন নি।
ইমাম সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, জিনের কারণে এ-রকম করে। জিনটা তার সঙ্গে-সঙ্গে আছে। মাঝে-মাঝে মাসখানিকের জন্য চলে যায়। তখন ভালো থাকে। গত এক মাস ধরে তার সাথে আছে।
আপনি এ-সব বিশ্বাস করেন?
বিশ্বাস করব না কেন? বিশ্বাস না-করার তো কিছু নাই। বাতাস আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু বাতাস বিশ্বাস করি। কারণ বাতাসের নানান আলামত দেখি। সেই রকম জিন কফিলেরও নানান আলামত দেখি।
কী দেখেন?
জিন যখন সঙ্গে থাকে, তখন লতিফা খুব সাজগোজ করে। কথায়-কথায় হাসে, কথায়-কথায় কাঁদে।
জিন তাড়াবার ব্যবস্থা করেন নি?
করেছি। লাভ হয় নাই। কফিল খুব শক্ত জিন। দীর্ঘদিন লতিফার সঙ্গে আছে।
প্ৰথম সন্তান যখন গৰ্ভে আসল তখন থেকেই কফিল আছে।
জিন চায় কী?
ইমাম সাহেব মাথা নিচু করে রইলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি কোনো কারণে খুব কষ্ট পাচ্ছেন। আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হল-জিন বোধহয় লতিফ মেয়েটিকেই স্ত্রী হিসেবে চায়। বিংশ শতাব্দীতে এই ধরনের চিন্তা মাথায় আসছে দেখে আমি নিজের ওপরও বিরক্ত হলাম। ইমাম সাহেব বললেন, এই জিনটা আমার দুইটা বাচ্চা মেরে ফেলেছে। আবার যদি বাচ্চা হয় তারেও মারবে। বড় মনকষ্টে আছি জনাব। দিন-রাত আল্লাহপাকেরে ডাকি। আমি গুনাহগার মানুষ, আল্লাহপাক আমার কথা শুনেন না।
আপনার স্ত্রীকে কোনো ডাক্তার দেখিয়েছেন?
ডাক্তার কী করবে? ডাক্তারের কোনো বিষয় না। জিনের ওষুধ ডাক্তারের কাছে নাই।
তবু একবার দেখালে হত না?
আমার শ্বশুরসাহেব দেখিয়েছিলেন। একবার লতিফাকে বাপের বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। শ্বশুরসাহেব তারে ঢাকা নিয়ে গেলেন। চিকিৎসাটিকিৎসা করালেন। লাভ হল না।
বারান্দা থেকে গুনগুন শব্দ আসছে। উৎকৰ্ণ হয়ে রইলাম—খুবই মিষ্টি গলায় টেনে- টেনে গান হচ্ছে—যার কথাগুলোর বেশির ভাগই অস্পষ্ট। মাঝে-মাঝে দু- একটা লাইন বোঝা যায়, যার কোনো অর্থ নেই। যেমন:
এতে না দেহে না দেহে না এতে না।
ইমাম সাহেব উঁচু গলায় বললেন, লতিফা, চুপ কর। চুপ কর বললাম।
গান থামিয়ে লতিফা বলল, তুই চুপ কর। তুই থাম শুয়োরের বাচ্চা।
অবিকল পুরুষের ভারি গলা। আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। সেই পুরুষকণ্ঠ থমথমে স্বরে বলল, চুপ কইরা থাকবি। একটা কথা কইলে টান দিয়া মাথা আলগা করুম। শইল থাকব একখানে মাথা আরেকখানে। শুয়োরের বাচ্চা আমারে চুপ করতে কয়।
আমরা হাত ধুয়ে উঠে পড়লাম। এত কাণ্ডের পর খাওয়াদাওয়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এ-জাতীয় যন্ত্রণায় পড়ব, কখনো ভাবি নি।
সফিক নিচু গলায় বলল, বিরাট সমস্যা হয়ে গেল দেখি ভয়ভয় লাগছে। কী করা যায় বল তো?
মসজিদের ভেতর এর আগে কখনো রাত্রি যাপন করি নি। অস্বস্তি নিয়ে ঘুমুতে গেলাম। কেমন যেন দম-বন্ধ দম-বন্ধ লাগছে। মসজিদের একটিামাত্র দরজা-সেটি পেছন দিকে। ভেতরে গুমোট ভাব! ইমাম সাহেব যত্বের চূড়ান্ত করেছেন। স্ত্রীর অস্বাভাবিক আচরণজনিত লজ্জা হয়তো-বা। ঢাকার চেষ্টা করেছেন। আমাদের জন্যে দুটো শীতল পাটি, পাটির চারপাশে কার্বলিক এসিড ছড়ানো হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা-দুটো মশারি খাটানো হয়েছে।
ইমাম সাহেব বললেন, ভয়ের কিছু নাই। হারিকেন জ্বালানো থাকবে। আলোতে সাপ আসে না। দরজা বন্ধ। সাপ ঢোকারও পথ নাই।