ইমাম সাহেব লাজুক মুখে বললেন, জ্বি। তার চায়ের অভ্যাস আছে। শহরের মেয়ে আমার শ্বশুরসাহেব হচ্ছেন নেত্রকোণার বিশিষ্ট মোক্তার মমতাজউদ্দিন! নাম শুনেছেন বোধহয়।
আমরা এমন ভঙ্গি করলাম যে নামটা আমাদের কাছে অপরিচিতি নয়, আগে অনেক বার শুনেছি।
ইমাম সাহেব বললেন, আমি চা খাই না। আমার স্ত্রীর চায়ের অভ্যাস আছে। শহর থেকে ভালো চায়ের পাতা এনে দিতে হয়। বিরাট খরচান্ত ব্যাপার।
আপনি কি ইমামতি ছাড়া আর কিছু করেন?
জ্বি-না। সামান্য জমিজমা আছে। আধি দেই। আমার শ্বশুর সাহেব তাঁর মেয়ের নামে নেত্রকোণা শহরে একটা ফার্মেসি দিয়েছেন-সানরাইজ ফার্মেসি। তার আয় মাসে-মাসে আসে। রিজিকের মালিক আল্লাহ্ পাক। তাঁর ইচ্ছায় চলে যায়।
ভালো চলে বলেই তো মনে হচ্ছে।
জ্বি জনাব, ভালোই চলে। সংসার ছোট ছেলেপূলে নাই।
এশার নামাজের সময় হয়ে গিয়েছিল। ইমামসাহেব আজান দিয়ে নামাজ পড়তে গেলেন। কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তিকে নামাজে আসতে দেখলাম না। ইমাম- সাহেবকে জিজ্ঞেস করে জুনলাম-আলোক এমনিতেই হত না। দু বছর ধরে একেবারেই হচ্ছে না। শুধু জুম্মাবারে কিছু মুসুল্লি আসেন।
লোকজন না-হওয়ার কারণও বিচিত্র। মসজিদ সম্পর্কে গুজব রটে গেছে, এখানে জিন থাকে। নাপাক অবস্থায় নামাজ পড়লে জিন তার সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। নানান ধরনের যন্ত্রণা করে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, জিন কি সত্যি-সত্যি আছে?
আছে। আল্লাহপাক কোরান মজিদে বলেছেন। একটা সূরা আছে–সুরায়ে জিন!
সেই কথা জিজ্ঞেস করছি না–জানতে চাচ্ছি জিন গিয়ে বিরক্ত করে এটা সত্যি কিনা।
জ্বি জনাব, সত্য। তবে লোকজন জিনের ভয়ে মসজিদে আসে না-এটা ঠিক না, আসলে সাপের ভয়ে আসে না।
সাপের ভয়ে আসে না। কী বলছেন আপনি?
একবার নামাজের মাঝখানে সাপ বের হয়ে গেল। দাঁড়াস সাপ। অবশ্য কাউকে কামড়ায় নাই। বাস্তুসাপ কামড়ায় না। মাঝেমধ্যে ভয় দেখায়।
সফিক আঁৎকে উঠে বলল, মাই গড়! যখন-তখন সাপ বের হলে এইখানে থাকব কীভাবে?
ভয়ের কিছু নাই। কার্বলিক এসিড ছড়ায়ে দিব।
কার্বলিক এসিড আছে?
জ্বি! নেত্রকোণার ফর্মেসি থেকে তিন বোতল নিয়ে আসছি। আমার স্ত্রীরও খুব সাপের ভয়। এই অঞ্চলে সাপখোপ একটু বেশি।
মসজিদের সামনে উঁচু চাতালমতো জায়গায় বসে আছি। সাপের ভয়ে খানিকটা আতঙ্কগ্ৰস্ত। আকাশে মেঘ ডাকছে। বড় ধরনের বর্ষণ মনে হচ্ছে আসন্ন। ইমাম সাহেব বুলুন, খাওয়া দিতে একটু দেরি হবে। আমার স্ত্রী সব একা করছে।–লোকজন নাই।
তাব দেখে মনে হচ্ছে-বিরাট আয়োজন।
জ্বি-না, আয়োজন কিছুনা, দরিদ্র মানুষ। আপনারা এসেছেন শুনে আমার স্ত্রী খুব খুশি। কেউ আসে না। আমি বলতে গেলে একা থাকি সবাই আমাকে ভয় করে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কেন?
সবার একটা ধারণা হয়েছে। আমি জিন পুষি। জিনদের দিয়ে কাজকর্ম
সত্য না জনাব। তবে মানুষ অসত্যকে সহজে বিশ্বাস করে! অসত্য বিশ্বাস করা সহজ, কারণ শয়তান অসত্য বিশ্বাসে সাহায্য করে।
ইমাম সাহেব বেশ মন খারাপ করে চুপ হয়ে গেলেন। প্রসঙ্গ পাল্টাবর জন্যে জিজ্ঞেস করলাম, সাধু কালু খাঁ সম্পর্কে কী জানেন?
ইমাম সাহেব বললেন, তেমন কিছু জানি না। তবে আপনাদের মতো দূর-দূর থেকে ওনার কাছে লোকজন আসে—এইটা দেখেছি। বিশিষ্ট ভদ্রলোকরাই আসে বেশি। ময়মনসিংহের ডি, সি, সাহেব ওনার পত্নীকে নিয়ে এসেছিলেন।
ওনার ক্ষমতাটমতা কিছু আছে?
মনে হয় না। কুৎসিত গালাগালি করেন। কামেল মানুষের এই রকম গালিগালাজ করার কথা না। তা ছাড়া কালু খাঁর কারণে অনেক বেদান্তী কাণ্ডকারখানা হয়। এইগুলাও ঠিক না।
কী কাগুকারখানা হয়?
উনি নগ্ন থাকেন। এইজন্য অনেকের ধারণা নগ্ন অবস্থায় তাঁর কাছে গেলে তাঁর মেজাজ ঠিক থাকে। অনেকেই নগ্ন অবস্থায় যান।
সে কী।
উনি পাগলমানুষ। সমস্যার কারণে যাঁরা তাঁর কাছে আসেন তাঁরাও এক অর্থে পাগল। পাগলামানুষের কাজকর্ম তো এই রকমই হয়। সমস্যা হলে তার পরিত্রাণের জন্য আল্লাহ্বপাকের দরবারে কান্নাকাটি করতে হয়। মানুষ তা করে না, সাধু-সন্ন্যাসী, পীর-ফকির খোঁজে।
ইমাম সাহেবের কথাবার্তায় আমি অবাক হলাম। পরিষ্কার চিন্তা-ভাবনা। গ্রাম্য মসজিদের ইমামের কাছ থেকে এমন যুক্তিনির্ভর কথা আশা করা যায় না। লোকটির প্রতি আমার একধরনের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হল। তা ছাড়া ভদ্রলোকের আচার-আচরণেও সহজ। সারল্য আছে, যে-সারল্যের দেখা সচরাচর পাওয়া যায় না।
রাত নটার দিকে ইমাম সাহেব বললেন, চলেন যাই, খানা বোধহয় এর মধ্যে তৈরি হয়েছে। ডাল-ভাত-এর বেশি কিছু না। নিজ গুণে ক্ষমা করে চারটা মুখে ইমাম সাহেবের বাড়িটা ছোট্ট টিনের দু-কামরার বাড়ি। একচিলতে উঠেন। বাড়ির চারদিকে দৰ্মার বেড়া! আমাদের ঘরে নিয়ে বসানো হল। মেঝেতে শতরঞ্জি বিছানো। থালা-বাসন সাজানো! আমরা সঙ্গে-সঙ্গে খেতে বসে গেলাম। খাবারের আয়োজন অল্প হলেও ভালো। সজি, ছোটো মাছের তরকারি, ডাল এবং টকজাতীয় একটা খাবার। ইমাম সাহেব আমাদের সঙ্গে বসলেন না। খাবার পরিবেশন করতে লাগলেন। খাবারের শেষ পর্যায়ে আমাদের অবাক করে দিয়ে ইমাম সাহেবের স্ত্রী ঘরে ঢুকলেন, এবং শিশুর মতো কৌতূহলী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ব্যাপারটা এত আচমকা ঘটল যে আমি বেশ হকচাকিয়েই গেলাম। অজ পাড়াগাঁয়ে এটা অভাবনীয়। কঠিন পর্দাপ্রথাই আশা করেছিলাম। আমি খানিকটা সংকুচিত হয়েই রইলাম! ইমাম সাহেবকেও দেখলাম খুব অপ্ৰস্তুত বোধ করছেন।