তাও মনে হচ্ছে। তবে একটা প্রবাবিলিটি আছে যে, সে উন্মাদ না।
গ্রামের কয়েক জন বয়স্ক মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন। সাধুর প্রতি তাঁদের ভক্তিশ্রদ্ধাও সফিকের মতোই। তাঁদের একজন বললেন, বাবার মাথা এখন একটু গরম।
আমি বিরক্ত গলায় বললাম, মাথা ঠাণ্ডা হবে কখন?
ঠিক নাই। চাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ।
চাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ মানে?
অমাবস্যা-পূর্ণিমায় মাথা গরম থাকে।
এই ব্যাপারেও মতভেদ দেখা গেল। একজন বলল, অমাবস্যামাথাটা ঠাণ্ডা থাকে। অন্য সময় গরম। বাবার কাছে মাসের পর মাস পড়ে থাকতে হয়। অপেক্ষা করতে হয়। কখন বাবার মাথা ঠাণ্ডা হবে।
আমি বললাম, সফিক, বাবার গা থেকে ফুলের গন্ধ তো কিছু পাচ্ছি না। আমাদের যে-দ্ৰব্য খেতে বলছিল তার গন্ধ পাচ্ছি। তুই কি পাচ্ছিস?
সফিক জবাব দেবার আগেই আমাদের সঙ্গী মানুষের একজন ভীত গলায় বলল, একটু দূরে যান। বাবা অখন টিল মারব। আইজ মনে হইতাছে বাবার মিজাজ বেশি খারাপ
কথা শেষ হবার আগেই টিলকৃষ্ট শুরু হল। দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলাম। বাবার কাণ্ডকারখানায় সফিকের অবশ্যি মোহভঙ্গ হল না। সে বেশ উৎসাহের সঙ্গেই বলল, দুটো দিন থেকে দেখি। এতদূর থেকে আসা। ভালো— মতো পরীক্ষা না-করে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
আর কী পরীক্ষা করবি?
মানে ওনার মাথা যখন ঠাণ্ডা হবে তখন দু-একটা কথাটথা জিজ্ঞেস করলে…
আমি হাল ছেড়ে দেওয়া গলায় বললাম, থাকবি কোথায়?
স্কুলঘরে শুয়ে থাকব। খানিকটা কষ্ট হবে। কী আর করা! কষ্ট বিনে কেষ্ট মেলে না।
জানা গেল। এই গ্রামে কোনো স্কুল নেই। পাশের গ্রামে প্রাইমারি স্কুল আছে-এখান থেকে ছ মাইলের পথ। তবে গ্রামে পাকা মসজিদ আছে। অতিথি মোসাফির এলে মসজিদে থাকে। মসজিদের পাশেই ইমাম সাহেব আছেন। তিনি অতিথিদের খোঁজখবর করেন। প্রয়োজনে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
আমি খুব একটা উৎসাহ বোধ করলাম না। গ্রামের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ইমাম সাহেব লোক কেমন?
সে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে দার্শনিকের মতো বলল, ভালোয়-মন্দয় মিলাইয়া মানুষ। কিছু ভালো, কিছু মন্দ।
এই উত্তরও আমার কাছে খুব সন্দেহজনক মনে হল। উপায় নেই। আকাশে আবার মেঘা জমতে শুরু করেছে। রওনা হলাম মসজিদের দিকে। গ্রামের লোকগুলো অভদ্রের চূড়ান্ত। কেউ সঙ্গে এল না। কীভাবে যেতে হবে বলেই ভাবল আমাদের জন্যে অনেক করা হয়েছে।
মসজিদ খুঁজে বের করতেও অনেক সময় লাগল।
অন্ধকার রাত। পথঘাট কিছুই চিনি না। সঙ্গে টর্চলাইট ছিল-বৃষ্টিতে ভিজে সেই টাৰ্চলাইটও কাজ করছে না। অন্ধের মতো এগুতে হচ্ছে। যাকেই জিজ্ঞেস করি সে-ই খুন্টু জেরা করে—সুমাঘরে যাইতে চান কান? কার কাছে যাইবেন? আপনের পরিচয়?
শেষ পর্যন্ত মসজিদ পাওয়া গেল। গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে একটা খালের পাশে মসজিদ। মসজিদের বয়স খুব কম হলেও দু, শ বছরের কম হবে না। বিশাল স্তুপের মতো একটা ব্যাপার। সেই স্তুপের সবটাই শ্যাওলায় ঢাকা। গা বেয়ে উঠেছে বটগাছ। সব মিলিয়ে কেমন গা-ছিমছামানি ব্যাপার আছে।
আমাদের সাড়াশব্দ পেয়ে হারিকেন হাতে ইমাম সাহেব চলে এলেন। ছোটখাটো মানুষ। খালি গা। কাঁধে গামছা চাদরের মতো জড়ানো। বয়স চল্লিশের মতো হবে। দাড়িতে তাকে খানিকটা আর্নেষ্ট হেমিংওয়ের মতো দেখাচ্ছে। আমার ধারণা ছিল মসজিদে রান্ত্রি যাপন করব। শুনে তিনি বিরক্ত হবেন। হল উল্টোটা। তাঁকে আনন্দিত মনে হল। নিজেই বালতি করে পানি এনে দিলেন। গামছা আনলেন। দু জোড়া খড়ম নিয়ে এলেন। সফিক বলল, ভাই, আমাদের খাওয়াদাওয়া দরকার। সারাদিন উপোস। টাকা পয়সা নিয়ে যদি খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
ইমাম সাহেব বললেন, ব্যবস্থা হবে জনাব। আমার বাড়িতেই গরিবি হালতে ডালভাতের ব্যবস্থা।
নাম কি আপনার?
মুনশি এর তাজউদ্দিন।
থাকেন কোথায়, আশেপাশেই?
মসজিদের পিছনে-ছোট্ট একটা টিনের ঘর আছে।
কে কে থাকেন?
আমার স্ত্রী, আর কেউ না।
ছেলেমেয়ে?
ছেলেমেয়ে নাই জনাব। আল্লাহপাক সন্তান দিয়েছিলেন, তাদের হায়াত দেন নাই। হায়াত-মউত সবই আল্লাহপাকের হাতে। আপনারা হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্ৰাম করেন, আমি আসতেছি।
ভদ্রলোক ছোট-ছোট পা ফেলে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সফিক বলল, ইমাম সাহেবকে নিতান্ত ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে। মাই ডিয়ার টাইপ। মনে হচ্ছে আমাদের দেখে খুশি হয়েছেন।
আমি বললাম, ভদ্রলোক জঙ্গুলে জায়গায় একা পড়ে আছেন-আমাদের দেখে সেই কারণেই খুশি। এই মসজিদে নামাজ পড়তে কেউ আসে বলে আমার মনে হয় না।
বুঝলি কি করে?
লোকজনের যাতায়াত থাকলে পায়ে চলার পথ থাকত। পথ দেখলাম না।
সফিক হাসতে— হাসতে বলল, মিসির আলির সঙ্গে থেকে-থেকে তোর অবজারভেশন পাওয়ার বেড়েছে বলে মনে হয়।
কিছুটা তো বেড়েছেই। ইমাম সাহেব আমাদের বসিয়ে রেখে যে চলে গেলেন, কী নিয়ে ফিরবেন জানিস?
কী নিয়ে?
দু হাতে দুটো কাটা ডাব নিয়ে।
এই তোর অনুমান?
আমি হাসিমুখে বললেন, মিসির আলি থাকলে এই অনুমানই করতেন। অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে গ্রামে প্রচুর ডাব গাছ। অতিথিদের ডাব দেওয়া সনাতন রীতি।
লজিক তো ভালোই মনে হচ্ছে।
আমার লজিক ভুল প্রমাণ করে মুনশি এর তাজউদ্দিন ট্রে হাতে উপস্থিত হলেন। টেতে দু কাপ চা। একবাটি তেল-মরিচ মাখা মুড়ি। এই অতি পাড়াগাঁ জায়গায় অভাবনীয় ব্যাপার তো বটেই। মফস্বলের চা অতিরিক্ত গরম, অতিরিক্ত মিষ্টি এবং অতিরিক্ত কড়া হয়। তবু চা হচ্ছে চা চৰ্বিশ ঘন্টা পর প্রথম চায়ে চুমুক দিলাম, মনটা ভালো হয়ে গেল। চমৎকার চা। বিস্মিত হয়ে বললাম, চা কে বানিয়েছে? আপনার স্ত্রী?