ছাত্ররা প্রায়ই এসে স্বপ্ন বলে যায়। ওদের কোনো স্বপ্ৰই তেমন ভয়ংকর না। সাপে তাড়া করছে, আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে-এই জাতীয় স্বপ্ন। আমার ইচ্ছা ছিল দুঃস্বপ্ন নিয়ে গবেষণার কিছু কাজ করব। সেই ইচ্ছা সফল হল না। দুঃস্বপ্ন দেখছে এমন লোকজনই পাওয়া গেল না। আমি গবেষণার কথা যখন ভুলে গেলাম, তখন এল লোকমান ফকির।
লোকমান ফকিরের বাড়ি কুমিল্লার নবীনগরে। বয়স ত্রিশ-পয়ত্রিশ। শিপিং করপোরেশনে মোটামুটি ধরনের চাকরি করে। দু-কামরার একটা বাড়ি ভাড়া করেছে। কাঁঠালবাগানে। বিয়ে করে নি। তবে বিয়ের চিন্তা-ভাবনা করছে। তার এক মামাতো বোনের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে মেয়েটিকে তার পছন্দ নয়। তবে অপছন্দের কথা সে সরাসরি বলতেও পারছে না। কারণ তার এই মামা তাকে পড়াশোনা করিয়েছেন।
ছেলেটি এক সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। আমি তাকে দেখে চমকে উঠলাম। মুখ পাণ্ডুর বর্ণ, মৃত মানুষের চোখের মতো ভাবলেশহীন চোখ। যৌবনের নিজস্ব যে-জ্যোতি যুবক-যুবতীর চোখে থাকে তার কিছুই নেই। ছেলেটি হাঁটছে খুঁড়িয়ে-খুড়য়ে, কিছুক্ষণ পরপরই চমকে উঠছে। সে ঘরে ঢুকেই বিনা ভূমিকায় বলল, স্যার, আপনি আমাকে বাঁচান।
আমি ছেলেটিকে বসালাম। পরিচয় নিলাম! হালকা কিছু কথাবার্তা বলে তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। তাতে খুব লাভ হল বলে মনে হল না। তার অস্থিরতা কমল না। লক্ষ করলাম, সে স্থির হয়ে বসতেও পারছে না। খুব নড়াচড়া করছে। আমি বললাম, তোমার সমস্যাটা কী?
ছেলেটি রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে-মুছতে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, স্যার, আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন।
আমি বললাম, দুঃস্বপ্ন দেখে না। এমন মানুষ তুমি খুঁজে পাবে না! সাপে তাড়া করছে, বাঘে তাড়া করছে, আকাশ থেকে নিচে পড়ে যাওয়া—এগুলি খুবই কমন স্বপ্ন। সাধারণত হজমের অসুবিধা হলে লোকজন দুঃস্বপ্ন দেখে। ঘুমের অসুবিধা হলেও দেখে! তুমি শুয়ে আছ, মাথার নিচ থেকে বালিশ সরে গেল, তখনো এ-রকম স্বপ্ন তুমি দেখতে পার। শারীরিক অস্বস্তির একটা প্রকাশ ঘটে দুঃস্বপ্নে। আগুনে পোড়ার স্বপ্ন। মানুষ কখন দেখে জানা? যখন পেটে গ্যাস হয়, সেই গ্যাসে বুক জ্বালাপোড়া করে— তখন সে স্বপ্ন দেখে তাকে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
স্যার, আমার স্বপ্ন এ-রকম না। অন্য রকম।
ঠিক আছে, গুছিয়ে বল। শুনে দেখি কী রকম।
ছেলেটি সঙ্গে-সঙ্গে কথা শুরু করল। মুখস্থ বলে যাবার মতো বলে যেতে লাগল! মনে হয় আগে থেকে ঠিকঠাক করে এসেছে এবং অনেক বার রিহার্সেল দিয়েছে।
কথা বলার সময় একবারও আমার চোখের দিকে তাকাল না। যখন প্রশ্ন করলাম তখনো না।
প্রথম স্বপ্নটা দেখি বুধবার রাতে। এগারটার দিকে ঘুমুতে গেছি! আমার ঘুমের কোনো সমস্যা নেই! শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়তে পারি। সে-রাতেও তাই হল! বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়েছি। সঙ্গে-সঙ্গেই স্বপ্নটা দেখেছি।
কী করে বুঝলে শোয়ামাত্র স্বপ্ন দেখেছ?
জেগে উঠে ঘড়ি দেখেছি, এগারটা দশ।
স্বপ্নটা বল।
আমি দেখলাম খোলামেলা একটা মাঠের মতো জায়গা। খুব বাতাস বইছে। শোশোঁ শব্দ হচ্ছে। রীতিমতো শীত লাগছে। আমার চারদিকে অনেক মানুষ, কিন্তু ওদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না! ওদের কথা শুনতে পাচ্ছি। হাসির শব্দ শুনছি? একটা বাচ্চা ছেলে কাঁদছে-তাও শুনছি। বুড়োমতো একটা লোকের কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কাউকে আবছাভাবেও দেখতে পাচ্ছি না। একবার মনে হল আমি বোধহয় অন্ধ হয়ে গেছি। চারদিকে খুব তীক্ষ্ণ চোখে তোকালাম–মাঠ দেখতে পাচ্ছি, কুয়াশা দেখতে পাচ্ছি-কিন্তু মানুষজন দেখছি না, অথচ তাদের কথা শুনছি। হঠাৎ ওদের কথাবার্তা সব থেমে গেল। বাতাসের শো-শোঁ শব্দও বন্ধ হয়ে গেল! মনে হল কেউ যেন এসেছে। তার ভয়ে সবাই চুপ করে গেছে। আমার নিজেরও প্রচণ্ড ভয় লাগল। একধরনের অন্ধ ভয়।
তখন শ্লেষ্মাজড়িত মোটা গলায় একজন বলল, ছেলেটি তো দেখি এসেছে। মেয়েটা কোথায়?
কেউ জবাব দিল না। খানিকক্ষণের জন্যে বাচ্চা ছেলেটির কান্না শোনা গেল, সঙ্গেসঙ্গে থেমেও গেল। মনে হল কেউ যেন তার মুখে হাত চাপা দিয়ে কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করছে। ভারি গলার লোকটা আবার কথা বলল, মেয়েটা দেরি করছে কেন? কেন এত দেরি? ছেলেটিকে তো বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। এর ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে। ও জেগে যাবে।
হঠাৎ চারদিকে সাড়া পড়ে গেল। একসঙ্গে সবাই বলে উঠল, এসেছে, এসেছে, মেয়েটা এসেছে। আমি চমকে উঠে দেখলাম আমার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব রোগা একটা মেয়ে। অসম্ভব ফরাসা, বয়স আঠার-উনিশ। এলোমেলোভাবে শাড়ি পরা। লম্বা চুল! চুলগুলি ছেড়ে দেওয়া, বাতাসে উড়ছে। মেয়েটা ভয়ে থারথার করে কাঁপছে। আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি। সে অসংকোচে আমার হাত ধরে কাপা গলায় বলল, আমার ভয় করছে। আমার ভয় করছে!
আমি বললাম, আপনি কে?
সে বলল, আমার নাম নাগিন্স। আপনি যা দেখছেন তা স্বপ্ন। ভয়ংকর স্বপ্ন! একটু পরই বুঝবেন। আগে এই স্বপ্নটা শুধু আমি একা দেখতাম। এখন মনে হয় আপনিও দেখবেন।
মেয়েটা কাঁদতে শুরু করল। আতঙ্কে অস্থির হয়ে আমার গা ঘেষে দাঁড়াল। কাঁদতেকাঁদতেই বলল, আপনি কিছু মনে করবেন না, আমার ভয় লাগছে বলেই আমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছি। এরা প্রতি মাসে একবার করে আমাকে এই স্বপ্নটা দেখায়।