আমি বললাম, এমনো তো হতে পারে যে, কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে।
হতে পারে। প্রচুর কাকতালীয় ব্যাপার পৃথিবীতে ঘটছে। তবে কাকতালীয় ব্যাপারগুলিকেও একটা স্ট্যাটিসটিক্যাল প্রবাবিলিটির ভেতর থাকতে হবে।। Precognition dream- এর ক্ষেত্রে তা থাকে না।
বুঝতে পারছি না।
বোঝানো একটু কঠিন। আমি বরং স্বপ্ন সম্পর্কে একটা গল্প বলি-শুনতে চান?
বলুন শুনি-ভৌতিক কিছু?
না–ভৌতিক না।–তবে রহস্যময় তো বটেই। আরেক দফা চা হয়ে যাক।
হোক।
কী ঠিক করলেন? থেকে যাবেন? বৃষ্টি বাড়ছে। আমি থেকে যাওয়াই ঠিক করলাম। মিসির আলি চা নিয়ে বিছানায় পা তুলে বসলেন। গল্প শুরু হল।
ছোটবেলায় আমাদের বাসায় খাবনামা নামে একটা স্বপ্নতত্ত্বের বই ছিল! কোন স্বপ্ন দেখলে কী হয় সব ঐ বইয়ে লেখা। আমার মা ছিলেন বইটার বিশেষ ভক্ত। ঘুম থেকে উঠেই বলতেন, ও মিসির, বইটা একটু দেখ তো। একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নের মানে কি বল!
আমি বই নিয়ে বসতাম।
দেখ তো বাবা, গরু স্বপ্ন দেখলে কী হয়।
আমি বই উল্টে জিজ্ঞেস করলাম, কী রঙের গরু, মা? সাদা না কালো?
এই তো মুশকিলে ফেললি, সাদা না কালো খেয়াল নেই।
সাদা রঙের গরু হলে—ধনলাভ। কালো রঙের গরু হলো-বিবাদ!
কার সঙ্গে বিবাদ? তোর বাবার সাথে?
লেখা নেই তো মা!
মা চিন্তিত হয়ে পড়তেন। স্বপ্ন নিয়ে চিন্তার তাঁর কোনো শেষ ছিল না। আর কত বিচিত্র স্বপ্ন যে দেখতেন—একবার দেখলেন দুটো অন্ধ চড়ুই পাখি। খাবনাময় অন্ধ চড়ুই পাখি দেখলে কী হয় লেখা নেই। কবুতর দেখলে কী হয় লেখা আছে। মার কারণেই খাবনামা ঘাঁটতে-ঘাঁটতে একসময় পুরো বইটা আমার মুখস্থ হয়ে গেল। স্বপ্নবিশারদ হিসেবে আমার নাম রটে গেল! যে যা দেখে আমাকে এসে অর্থ জিজ্ঞেস করে। এই করতে গিয়ে জানলাম কত বিচিত্র স্বপ্নই না মানুষ দেখে। সেই সঙ্গে মজারমজার কিছু জিনিসও লক্ষ করলাম। যেমন-অসুস্থ মানুষরা সাধারণত বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখে। বোকা মানুষদের স্বীপুগুলি হয়। সরল ধরনের। বুদ্ধিমান মানুষরা খুব জটিল স্বপ্ন দেখে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা একটা স্বপ্ন প্রায়ই দেখে, সেটা হচ্ছে কোনো একটি অনুষ্ঠানে সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে উপস্থিত হয়েছে। সবার গায়ে ভালো পোশাকআশাক, শুধু সে-ই পুরোপুরি নগ্ন কেউ তা লক্ষ করছে না!
মিসির আলি সাহেব কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই জাতীয় স্বপ্ন কি আপনি কখনো দেখেছেন?
আমি বললাম, না। একটা স্বপ্নই আমি বারবার দেখি-পরীক্ষা হলে পরীক্ষা দিতে বসেছি। খুব সহজ প্রশ্ন, সবগুলির উত্তর আমার জানা। লিখতে গিয়ে দেখি কলম দিয়ে কালি বেরুচ্ছে না। কলামটা বদলে অন্য কলম নিলাম।–সেটা দিয়েও কালি বেরুচ্ছে না। এদিকে ঘন্টা পড়ে গেছে।
এই স্বপ্নটাও খুব কমন। আমিও দেখি। একবার দেখলাম বাংলা পরীক্ষা- প্রশ্ন দিয়েছে অঙ্কের। কঠিন সব অঙ্ক। বান্দরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার অঙ্ক! একটা বঁদরের জায়গায় দুটো বাঁদর। একটা খানিকটা ওঠে, অন্যটা তার লেজ ধরে টেনে নিচে নামায়া-খুবই জটিল ব্যাপার। বাঁশের সবটা আকার তৈলাক্ত না, কিছুটা তেল ছাড়া…..
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, সত্যিই কি এমন স্বপ্ন দেখেছেন?
জ্বি-না-ঠাট্টা করে বলছি।–জটিল সব অঙ্ক ছিল, এইটুকু মনে আছে। যাই হোক, ছোটবেলা থেকেই এইসব কারণে স্বপ্নের দিকে আমি ফুকলাম। দেশের বাইরে যখন প্যারাসাইকোলজি পড়তে গেলাম।–তখন স্পেশাল টপিক নিলাম ট্রম। স্ট্রীম ল্যাবোরেটরিতে কাজও করলাম। আমার প্রফেসর ছিলেন ডঃ সুইন হার্ন, দুঃস্বপ্নের ব্যাপারে যাকে পৃথিবীর সেরা বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারে। দুঃস্বপ্ন অ্যানালিসিসের তিনি একটা টেকনিক বের করেছেন, যার নাম সুইন হার্ন অ্যানালিসিস। সুইন হার্ন অ্যানালিসিসে ব্যাখ্যা করা যায় না। এমন সব দুঃস্বপ্নের একটা ফাইল তাঁর কাছে ছিল। সেই ফাইল তিনি তাঁর গ্রাজুয়েট ছাত্রদের দিতেন না। আমাকে তিনি খুবই পছন্দ করতেন, সম্ভবত সে-কারণেই সেই ফাইল ঘাঁটার সুযোগ হয়ে গেল। ফাইল পড়ে আমি হতভম্ব। ব্যাখ্যাতীত সব ব্যাপার। একটা উদাহরণ দিই-নিউ ইংল্যাণ্ডের একটি তেইশ বছর বয়েসী মেয়ে দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করল। তার নাভিমূল থেকে একটা হাত বের হয়ে আসছে। স্বাভাবিক হাতের চেয়ে সরু-লম্বা-লম্বা আঙুল হাতটার রঙ নীলচে-খুব তুলতুলে। দুঃস্বপ্নটা সে প্রায়ই দেখতে লাগল! প্রতিবারই স্বপ্ন ভাঙত বিকট চিৎকারে। তাকে ড্রীম ল্যাবোরেটরিতে ভর্তি করা হল। প্রফেসর সুইন হার্ন রোগিণীর মনোবিশ্লেষণ করলেন। অস্বাভাবিক কিছুই পেলেন না। মেয়েটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হল নিউ ইংল্যাণ্ডে। তার কিছুদিন পর মেয়েটি লক্ষ করল তার নাভিমূল ফুলে উঠেছে-একধরনের ননম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ হচ্ছে। একমাসের মধ্যে সেই টিউমার মানুষের হাতের আকৃতি ধারণ করল। টিউমারটির মাথায় মানুষের হাতের আঙুলের মতো পাঁচটি আঙুল…
আমি মিসির আলিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ভাই, এই গল্পটা থাক! শুনতে ভালো লাগছে না। ঘেন্না লাগছে!
ঘেন্না লাগার মতোই ব্যাপার। ছবি দেখলে আরো ঘেন্না লাগবে। মেয়েটির ছবি ছাপায়ুছািট ইংল্যাও জার্নাল অব ডেসিনে। ছবি দেখতে চান?
জি-না।
পিএইচ. ডি. প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম, পিএইচ. ডি. না-করেই ফিরতে হল! প্রফেসরের সঙ্গে ঝামেলা হল। যে-লোক আমাকে এত পছন্দ করত, সে-ই বিষনজরে দেখতে লাগল। এম. এস. ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্ট টাইম টীচিং-এর একটা ব্যবস্থা হল। ছাত্রদের অ্যাবনরম্যাল বিহেভিয়ার পড়াই। স্বপ্ন সম্পর্কেও বলি। স্বপ্নের সঙ্গে মানুষের অস্বাভাবিক আচরণের একটা সম্পর্ক বের করার চেষ্টা করি। ছাত্রদের বলি, তোমরা যদি কখনো কোনো ভয়ংকর স্বপ্ন দেখ, তাহলে আমাকে বলবে।