নাম যেমন অদ্ভুত, জায়গাও তেমন জঙ্গুলে। একবার গিয়ে পৌঁছলে মনে হবে সত্যসমাজের বাইরে চলে এসেছি। সেখানে যাবার ব্যবস্থাটা বলি-প্রথমে যেতে হবে ঠাকারোকোণা। ময়মনসিংহ-মোহনগঞ্জ ব্রাঞ্চ-লাইনের ছোট্ট স্টেশন। ঠাকরোকোণা থেকে গয়নার নৌক যায় হাতির বাজার পর্যন্ত। যেতে হবে হাতির বাজারে। ভাগ্য ভালো হলে হাতির বাজারে কেরায়া নৌকা পাওয়া যাবে। যদি পাওয়া যায়। সেই নৌকায় শিয়ালজানি খাল ধৱে মাইল দশেক উত্তরে যেতে হবে। বাকি পথ পায়ে হেঁটে। পেরুতে হবে মাঠ, ডোবা, জলাভূমি। জুতো খুলে হাতে নিয়ে নিতে হবে। পা কাটবে ভাঙা শামুকে। গোটা বিশেক জোঁক ধরবে। বিশ্ৰী অবস্থা কতটা হাঁটতে হবে তারও অনুমান নেই। একেক জন একেক কথা বলবে? একটা সময় আসবে যখন লোকজন সুপ্রিমুখ স্কুল-থুগুল নাড়া ঐ তো দেখা যায়। তখন বুঝতে হবে আরো মাইল সাতেক বাকি।
বছর পাঁচেক আগে এই জঙ্গুলো জায়গায় আমাকে জনৈক সাধুর সন্ধানে যেতে হয়েছিল। সাধুর নাম—কালু খাঁ। মুসলমান নাম হলেও সাধু হিন্দু ব্রাহ্মণ। বাবা-মা তাঁকে শৈশবেই পরিত্যাগ করেন। তিনি মানুষ হন মুসলিম পরিবারে। কালু খাঁ নাম তাঁর মুসলমান পালক বাবার দেওয়া। যৌবনে তিনি সংসারত্যাগী হয়ে শ্মশানে আশ্রয় নেন। তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা, বিভূতির কোনো সীমাসংখ্যা নেই। তিনি কোনোরকম খাদ্য গ্ৰহণ করেন না। তাঁর গা থেকে সবসময় কাঁঠালচাঁপু ফুলের তীব্ৰ গন্ধ বের হয়। পূৰ্ণিমার সময় সেই গন্ধ এত তীব্র হয় যে, কাছে গেলে বমি এসে যায়। নাকে রুমাল চেপে কাছে যেতে হয়।
সাধু-সন্ন্যাসী, তাঁদের অলৌকিক ক্ষমতা এইসব নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাই না। আমি মনেপ্ৰাণে বিশ্বাসু করি।–ব্যাখ্যার অতীত কোনো ক্ষমতা প্রকৃতি দেয় নি। কোনো সাধু যদি আমার চোখের সামনে শূন্যে ভাসতে থাকেন, আমি চমৎকৃত হব না। ধরে নেব। এর পিছনে আছে ম্যাজিকের সহজ কিছু কলাকৌশল, যা এই সাধু আয়ত্ত করেছেন। কাজেই আমার পক্ষে সাধুর খোঁজে ধুন্দুল নাড়া নামের অজ পাড়াগায় যাবার প্রশ্নই আসে না। যেতে হয়েছিল সফিকের কারণে।
সফিক আমার বাল্যবন্ধু। সে বিশ্বাস করে না এমন জিনিস নেই। ভূত-প্রেত থেকে সাধু-সন্ন্যাসী সবকিছুতেই তার অসীম বিশ্বাস। বিংশ শতাব্দীর মানুষ হয়েও সে বিশ্বাস করে যে, সাপের মাথায় মণি আছে। কৃষ্ণপক্ষের রাতে এই মণি সে উগরে ফেলে। চারদিক আলো হয়ে যায়। আলোয় আকৃষ্ট হয়ে পোক-মাকড় আসে। সাপ তাদের ধরেধরে খায়। ভোজনপর্ব শেষ হলে আবার গিলে ফেলে।
সাধু কালু খাঁর খবর সফিকই নিয়ে এল এবং এমন ভাব করতে লাগল যে, অবতারের সন্ধান পেয়ে গেছে।–যে-অবতারের সঙ্গে দেখা না হলে জীবন বৃথা।
আমি সফিকের সঙ্গে রওনা হলাম দুটি কারণে—এক, সফিককে অত্যন্ত পছন্দ করি। তাকে এক-একা ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। দুই, সাধু খোঁজা উপলক্ষে গ্রামের দিকে খানিকটা হলেও ঘোরা হবে। মাঝে-মাঝে এ-রকম ঘুরে বেড়াতে মন্দ লাগে না। নিজেকে পরিব্রাজক-পরিব্রাজক মনে হয়। যেন আমি ফা হিয়েন। বাংলার পথে-পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
খুব আগ্রহ নিয়ে রওনা হলেও আগ্রহ হাতির বাজারে পৌঁছবার আগেই শেষ হয়ে গেল। অমানুষিক পরিশ্রম হল। হাতির বাজার থেকে যে-কেরায়া নৌকা নিলাম সেনৌকাও এখন ডোবে তখন ডোবে অবস্থা। নৌকার পাটাতনের ফুটা দিয়ে বিজবিজ করে পানি উঠছে। সারাক্ষণ সেই পানি সোঁচতে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সফিকের মতো পাগলেরও ধৈর্যচ্যুতি হল। কয়েক বার বলল, বিরাট বোকামি হয়েছে। গ্রেট মিসটেক। এর চেয়ে কঙ্গো নদীর উৎস বের করা সহজ ছিল।
আমি বললাম, এখনো সময় আছে। ফিরে যাবি কি না বল।
আরে না। এতদূর এসে ফিরে যাব মানে! ভালো জিনিসের জন্যে কষ্ট করতেই হবে। জািষ্ট চিন্তা করে দেখু-একজন মানুষের গা থেকে ভূত্রভুর করে কাঁঠালচাঁপা ফুলের গন্ধ বেরুচ্ছে। ভাবতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে হাউ এক্সাইটিং।
সন্ধ্যার পরপর ধুন্দুল নাড়া গ্রামে উপস্থিত হলাম। কাদায় পানিতে মাখামাখি। তিন বার বৃষ্টিতে ভিজেছি। ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় জীবন বের হবার উপক্রম। বিদেশি মানুষ দেখলেই গ্রামের লোকজন সাধারণত খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে। এইখানে উন্টে নিয়ম দেখলাম। আমাদের ব্যাপারে কারো কোনো অনুগ্রহ নেই। কোথেকে এসেছি? যাবো কোথায়? দায়িত্ব পালন করার ভঙ্গিতে এইটুকু জিজ্ঞেস করেই সবাই চলে যাচ্ছে! এ কী যন্ত্রণা!
সাধু কালু খাঁ-কে দেখেও খুব হতাশ হতে হল। বদ্ধ উন্মাদ একজন মানুষ। শ্মশানে একটা পাকুড় গাছের নিচে ন্যাংটো অবস্থায় বসা। আমাদের দেখেই গালাগালি শুরু করল! গালাগালি যে এত নোংরা হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমাকে এবং সফিককে কালু খাঁ সবচেয়ে ভদ্ৰ কথা যা বলল তা হচ্ছে, বাড়িত্ যা। বাড়িত্ গিয়া খাবলাইয়া-খাবলাইয়া গু খা।
আমি হতভম্ব। ব্যাটা বলে কী।
সফিকের দিকে তাকলাম। সে ভাব-গদগদ স্বরে বলল, লোকটার ভেতর জিনিস আছে বলে মনে হচ্ছে।
আমি বললাম, কী করে বুঝলি? আমাদের গু খেতে বলেছে, এই জন্যে?
আরে না। সে আমাদের এড়াতে চাচ্ছে। মানুষের সংসর্গ পছন্দ নয়। মানুষের হোত থেকে উদ্ধার পাওয়ার এটা সহজ টেকনিক।
লোকটা যে বদ্ধ উন্মাদ, তা তোর মনে হচ্ছে না?