না, ঘামাই না।
সৃস্টিকর্তা নিয়ে মাথা ঘামান? হ্যাঁ, ঘামাই। খুব চিন্তা করি, কোনো কুল-কিনারা পাই না। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মগ্রন্থ কী বলে, জানেন? বলে—সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর পারেন না এমন কিছুই নেই। তিনি সব পারেন। অথচ আমার ধারণা তিনি দুটো জিনিস পারেন না, যা মানুষ পারে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, উদাহরণ দিন।
সৃস্টিকর্তা নিজেকে ধ্বংস করতে পারেন না-মানুষ পারে। আবার সৃস্টিকর্তা দ্বিতীয় একজন সৃষ্টিকর্তা তৈরি করতে পারেন না। মানুষ কিন্তু পারে, সে সন্তানের জন্ম দেয়।
আপনি তাহলে একজন নাস্তিক?
না, আমি নাস্তিক না। আমি খুবই আস্তিক। আমি এমন সব রহস্যময় ঘটনা আমার চারপাশে ঘটতে দেখেছি যে বাধ্য হয়ে আমাকে অস্তিক হতে হয়েছে। ব্যাখ্যাতীত সব ঘটনা। যেমন স্বপ্নের কথাটাই ধরুন। সামান্য স্বপ্ন, অথচ ব্যাখ্যাতীত একটা ঘটনা।
ব্যাখ্যাতীত হবে কেন? ফ্লয়েড তো চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন বলে শুনেছি।
মোটেই চমৎকার ব্যাখ্যা করেন নি। স্বপ্নের পুরো ব্যাপারটাই তিনি অবদমিত কামনার ওপর চাপিয়ে দিয়ে লিখলেন—Interpretations of dream। তিনি শুধু বিশেষ একধরনের স্বপ্নই ব্যাখ্যা করলেন। অন্য দিক সম্পর্কে চুপ করে রইলেন। যদিও তিনি খুব ভালো করে জানতেন মানুষের বেশ কিছু স্বপ্ন আছে, যা ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি এই নিয়ে প্রচুর কাজও করেছেন, কিন্তু প্রকাশ করেন নি। নষ্ট করে ফেলেছেন! তাঁর ছাত্র প্রফেসর ইয়ুং কিছু কাজ করেছেন—মূল সমস্যায় পৌঁছতে পারেননি,বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, কিছু-কিছু স্বপ্ন মানুষ কেন দেখে তা বলা যাচ্ছে না। যেমন-একটা লোক স্বপ্ন দেখল, হঠাৎ মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা খুলে পড়ে গেল। স্বপ্ন দেখার দু দিন পর দেখা গেল। সত্যি-সত্যি সিলিং ফ্যান খুলে পড়ে গেছে। এই ধরনের স্বপ্নকে বলে প্রিগগ্নিশন ড্রীম (Precognition dream)। এর একটিই ব্যাখ্যা—স্বপ্নে মানুষ ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে—যা সম্ভব নয়। কাজেই এ-জাতীয় স্বপ্ন ব্যাখ্যাতীত।
আমি বললাম, এমনো তো হতে পারে যে, কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে।
হতে পারে। প্রচুর কাকতালীয় ব্যাপার পৃথিবীতে ঘটছে। তবে কাকতালীয় ব্যাপারগুলিকেও একটা স্ট্যাটিসটিক্যাল প্রবাবিলিটির ভেতর থাকতে হবে।। Precognition dream- এর ক্ষেত্রে তা থাকে না।
বুঝতে পারছি না।
বোঝানো একটু কঠিন। আমি বরং স্বপ্ন সম্পর্কে একটা গল্প বলি-শুনতে চান?
বলুন শুনি-ভৌতিক কিছু?
না–ভৌতিক না।–তবে রহস্যময় তো বটেই। আরেক দফা চা হয়ে যাক।
হোক।
কী ঠিক করলেন? থেকে যাবেন? বৃষ্টি বাড়ছে। আমি থেকে যাওয়াই ঠিক করলাম। মিসির আলি চা নিয়ে বিছানায় পা তুলে বসলেন। গল্প শুরু হল।
ছোটবেলায় আমাদের বাসায় খাবনামা নামে একটা স্বপ্নতত্ত্বের বই ছিল! কোন স্বপ্ন দেখলে কী হয় সব ঐ বইয়ে লেখা। আমার মা ছিলেন বইটার বিশেষ ভক্ত। ঘুম থেকে উঠেই বলতেন, ও মিসির, বইটা একটু দেখ তো। একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নের মানে কি বল!
আমি বই নিয়ে বসতাম।
দেখ তো বাবা, গরু স্বপ্ন দেখলে কী হয়।
আমি বই উল্টে জিজ্ঞেস করলাম, কী রঙের গরু, মা? সাদা না কালো?
এই তো মুশকিলে ফেললি, সাদা না কালো খেয়াল নেই।
সাদা রঙের গরু হলে—ধনলাভ। কালো রঙের গরু হলো-বিবাদ!
কার সঙ্গে বিবাদ? তোর বাবার সাথে?
লেখা নেই তো মা!
মা চিন্তিত হয়ে পড়তেন। স্বপ্ন নিয়ে চিন্তার তাঁর কোনো শেষ ছিল না। আর কত বিচিত্র স্বপ্ন যে দেখতেন—একবার দেখলেন দুটো অন্ধ চড়ুই পাখি। খাবনাময় অন্ধ চড়ুই পাখি দেখলে কী হয় লেখা নেই। কবুতর দেখলে কী হয় লেখা আছে। মার কারণেই খাবনামা ঘাঁটতে-ঘাঁটতে একসময় পুরো বইটা আমার মুখস্থ হয়ে গেল। স্বপ্নবিশারদ হিসেবে আমার নাম রটে গেল! যে যা দেখে আমাকে এসে অর্থ জিজ্ঞেস করে। এই করতে গিয়ে জানলাম কত বিচিত্র স্বপ্নই না মানুষ দেখে। সেই সঙ্গে মজারমজার কিছু জিনিসও লক্ষ করলাম। যেমন-অসুস্থ মানুষরা সাধারণত বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখে। বোকা মানুষদের স্বীপুগুলি হয়। সরল ধরনের। বুদ্ধিমান মানুষরা খুব জটিল স্বপ্ন দেখে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা একটা স্বপ্ন প্রায়ই দেখে, সেটা হচ্ছে কোনো একটি অনুষ্ঠানে সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে উপস্থিত হয়েছে। সবার গায়ে ভালো পোশাকআশাক, শুধু সে-ই পুরোপুরি নগ্ন কেউ তা লক্ষ করছে না!
মিসির আলি সাহেব কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই জাতীয় স্বপ্ন কি আপনি কখনো দেখেছেন?
আমি বললাম, না। একটা স্বপ্নই আমি বারবার দেখি-পরীক্ষা হলে পরীক্ষা দিতে বসেছি। খুব সহজ প্রশ্ন, সবগুলির উত্তর আমার জানা। লিখতে গিয়ে দেখি কলম দিয়ে কালি বেরুচ্ছে না। কলামটা বদলে অন্য কলম নিলাম।–সেটা দিয়েও কালি বেরুচ্ছে না। এদিকে ঘন্টা পড়ে গেছে।
এই স্বপ্নটাও খুব কমন। আমিও দেখি। একবার দেখলাম বাংলা পরীক্ষা- প্রশ্ন দিয়েছে অঙ্কের। কঠিন সব অঙ্ক। বান্দরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার অঙ্ক! একটা বঁদরের জায়গায় দুটো বাঁদর। একটা খানিকটা ওঠে, অন্যটা তার লেজ ধরে টেনে নিচে নামায়া-খুবই জটিল ব্যাপার। বাঁশের সবটা আকার তৈলাক্ত না, কিছুটা তেল ছাড়া…..
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, সত্যিই কি এমন স্বপ্ন দেখেছেন?