লতিফা কাঁদতে-কাঁদতে বলল, আল্লাহ আপনার ভালো করবে। আল্লাহ্ আপনার ভালো করবে।
আপনি কোনো রকম চিন্তা করবেন না। আপনার অসুখ সেরে গেছে। আর কোনো দিন হবে না।
লতিফা তার স্বামীর কানো-কানে কী যেন বলল! ইমাম সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, জনাব, কিছু মনে করবেন না। লতিফা আপনারে একটু ছুঁইয়া দেখতে চায়।
মিসির আলি হাত বাড়িয়ে দিলেন। লতিফা দু’হাতে সেই হাত জড়িয়ে ধরে শিশুর মত চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
নৌকায় উঠছি।
ইমাম সাহেব আমাদের তুলে দিতে এলেন। নৌকা ছাড়ার আগ-মুহূর্তে নিছু গলায় বললেন, ভাইসাহেব, আমি অতি দরিদ্র মানুষ, আপনাদের যে কিছু দিব আন্নাহ্রপাক আমাকে সেই ক্ষমতা দেন নাই। এই কোরান শরিফাঁটা আমার দীর্ঘ দিনের সঙ্গী। যখন মন খুব খারাপ হয় তখন পড়ি-মন শান্ত করি। আমি খুব খুশি হব। যদি কোরান মজিদটি আপনি নেন। আপনি নিবেন কি না তা অবশ্য জানি না।
মিসির আলি বললেন, অবশ্যই নেব। খুব আনন্দের সঙ্গে নেব। ভাইসাহেব, আমার মেয়েটার একটা নাম কি আপনি রাইখা যাইবেন? মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ, যাব। আপনার মেয়ের নাম রাখলাম লাবণ্য। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এই নামের একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। মেয়েটা আমাকে একেবারেই পাত্তা দেয় নি। মাঝেমাঝেই মেয়েটার কথা আমার মনে হয়। মনটা খারাপ হয়ে যায়। ভাই, যাই।
মিসির আলি বললেন, গল্প শুনবেন নাকি?
আমি ঘড়ির দিকে তাকলাম। রাত মন্দ হয় নি। দশটার মতো বাজে। বাসায়
ফেরা দরকার। আকাশের অবস্থাও ভালো না। গুড়গুড করে মেঘ ডাকছে। আষাঢ় মাস।
যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে।
আমি বললাম, আজ থাক, আরেক দিন শুনব। রাত অনেক হয়েছে। বাসায় চিন্তা করবে।
মিসির আলি হেসে ফেললেন।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, হাসছেন কেন?
মিসির আলি হাসাতে-হাসতেই বললেন, বাসায় কে চিন্তা করবে? আপনার স্ত্রী কি বাসায় আছেন? আমার তো ধারণা তিনি রাগ করে বাচ্চাদের নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে গেছেন।
মিসির আলির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং সামান্য সূত্র ধরে সিদ্ধান্তে চলে যাবার প্রায় অলৌকিক ক্ষমতার সঙ্গে আমি পরিচিত। তবুও বিস্মিত হলাম। আমার স্ত্রীর সঙ্গে আজ দুপুরেই বড় ধরনের ঝগড়া হয়েছে। সন্ধ্যাবেলায় সে সুটকেস গুছিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে। এক-একা খালি বাড়িতে থাকতে অসহ্য বোধ হচ্ছিল বলে মিসির আলির কাছে এসেছি, তবে এই ঘটনার কিছুই বলি নি। আগ বাড়িয়ে পারিবারিক ঝগড়ার কথা বলে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না।
আমি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললাম, ঝগড়া হয়েছে বুঝলেন কী করে?
অনুমানে বলছি।
অনুমানটাই-বা কী করে করলেন?
আমি লক্ষ করলাম, আপনি আমার কাছে কোনো কাজে আসেন নি। সময় কাটাতে এসেছেন। গল্প করছেন এবং আমার গল্প শুনছেন। কোনো কিছুতেই তেমন আনন্দ পাচ্ছেন না। অর্থাৎ কোনো কারণে মন বিক্ষিপ্ত। আমি বললাম, ভাবি কেমন আছেন? আপনি বললেন, ভালো! কিন্তু বলার সময় আপনার মুখ কঠিন হয়ে গেল। অর্থাৎ ভাবির সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। আমি তখন নিশ্চিত হবার জন্যে বললাম, আমার সঙ্গে চারটা ভাত খান। আপনি রাজি হয়ে গেলেন। আমি ধরে নিলাম।–রাগারগি হয়েছে এবং আপনার স্ত্রী বাসায় নেই। আপনার এক-এক লাগছে বলেই আপনি এসেছেন আমার কাছে। এই সিদ্ধান্তে আসার জন্যে শার্লক হোমস হতে হয় না। একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই বোঝা যায়।
আমি কিছু বললাম না। মিসির আলি বললেন, চা চড়াচ্ছি। চা খেয়ে গল্প শুনুন, তারপর এইখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। খালি বাসায় এক-একা রাত কাটাতে ভালো লাগবে না। তা ছাড়া বৃষ্টি নামল বলে।
এটাও কি আপনার লজিক্যাল ডিডাকশান?
না—এটা হচ্ছে উইশফুল থিংকিং। গরমে কষ্ট পাচ্ছি–বৃষ্টি হলে জীবন বাঁচে। তবে বাতাস ভারি, বৃষ্টির দেরি নেই বলে আমার ধারণা।
বাতাসের আবার হালকা-ভারি কী?
আছে। হালকা-ভারির ব্যাপার আছে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ যখন বেড়ে যায় বাতাস হয় ভারি। সেটা আমি বুঝতে পারি মাথায় চুলে হাত দিয়ে। জলীয় বাষ্পের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে মাথার চুল নরম বা শক্ত হয়। শীতকালে মাথার চুলে হাত দিয়ে দেখবেন একরকম, আবার গরমকালে যখন বাতাসে হিউমিডিটি অনেক বেশি, তখন অন্যরকম।
আমার কাছে তো সবসময় একরকম লাগে।
মিসির আলি ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলেন। ভাবটা এ-রকম, যেন এর চেয়ে মজার কথা আগে শোনেন নি। আমি বোকার মতো বসে রইলাম। অস্বস্তিও লাগতে লাগল। খুব বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গে গল্প করার মধ্যেও একধরনের অস্বস্তি থাকে। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়।
মিসির আলি ক্টোড়ে চায়ের পানি বসিয়ে দিলেন। শৌ-শোঁ শব্দ হতে লাগল। এই যুগে ক্টোভ প্রায় চোখেই পড়ে না। মিসির আলি এই বস্তু কেথেকে জোগাড় করেছেন। কে জানে! কিছুক্ষণ পরপর পাম্প করতে হয়। অনেক যন্ত্রণা।
চায়ের কপি হাতে বিছানায় এসে বসামাত্র বৃষ্টি শুরু হল। তুমুল বর্ষণ। মিসির আলি বললেন, আমার বেহেশতে যেতে ইচ্ছা করে না কেন জানেন?
জানি না।
বেহেশতে যেতে ইচ্ছা করে না-করণ সেখানে ঝড়-বৃষ্টি নেই। এয়ারকুলার বসানো একটা ঘরের মতো সেখানকার আবহাওয়া। তাপ বাড়বেও না, কমবেও না! অনন্ত কাল একই থাকবে। কোনো মানে হয়?
আপনি কি বেহেশত-দোজখ এইসব নিয়ে মাথা ঘামান?