শ্রাবণ মাসের তিন তারিখে লতিফার একটা পুত্রসন্তান হল। কী সুন্দর যে ছেলেটা হল ভাইসাহেব, না-দেখলে বিশ্বাস করবেন না। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রঙ। টানাটানা চোখ। আমি এক শ রাকাত শোকরানা নামাজ পড়ে আল্লাহ্র কাছে আমার সন্তানের হায়াত চাইলাম। আমার মনের অস্থিরতা কমল না।
আঁতুড়ঘরের বাইরে একটা বেঞ্চ পেতে রাতে শুয়ে থাকি। আমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন আমার শাশুড়ি আর আমার স্ত্রীর দূর সম্পর্কের এক খালাতো বোন। পালা করে কেউ-না-কেউ সারা রাত জেগে থাকি।
লতিফার চোখে এক ফোটাও ঘুম নাই। সন্তানের মা। সারাক্ষণ বাচ্চা বুকের নিচে আড়াল করে রাখে। এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করে না। আমার শাশুড়ি যখন বাচ্চা কোলে নেন। তখনো লতিফ বাচ্চাটার গায়ে হাত দিয়ে রাখে, যেন কেউ নিয়ে যেতে না পারে।
ছয় দিনের দিন কি হল শুনেন।
ঘোর বর্ষ। সারা দিন বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যার পর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। এ-রকম বর্ষা আমি আমার জীবনে দেখি নাই।
লতিফা আমাকে বললো, আইজরাইতটা আপনে জাগনা থাকবেন। আমার কেমন জানি লাগতেছে।
আমি বললাম, কেমন লাগতেছে?
জানি না। একটু পরে-পরে শরীর কাঁপতেছে।
তুমি নিশ্চিন্ত হইয়া থাক। আমি সারা রাইত জগনা থাকব।
আপনে একটু বলরামরেও খবর দেন। সেও যেন জগন্না থাকে।
আমি বলরামকে খবর দিলাম। লতিফ বাচ্চাটারে বুকের নিচে নিয়া শুইয়া আছে। আমি একমনে আল্লাহপাকেরে ডাকতেছি। জীবন দেওয়ার মালিক তিনি। জীবন নেওয়ার মালিকও তিনি।
রাত তখন কত আমি জানি না ভাইসাহেব। ঘুমায়ে পড়েছিলাম। লতিফার চিৎকারে ঘুম ভাঙিল। সে আসমান ফাটাইয়া চিৎকার করতেছে। আমার বাচ্চা কই গেল-আমার বাচ্চা কই। হারিকেন জ্বালানো ছিল, নিভানো! পুরা বাড়ি অন্ধকার। কাঁপতে-কাঁপতে হারিকেন জ্বালালাম। দেখি সত্যি বাচ্চা নাই। আমার শাশুড়ি ফিট হয়ে পড়ে গেলেন।
লতিফা ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ছুটে গেল কুয়ার কুয়ার উপর টিন দিয়া ঢাকা ছিল। তাকায়ে দেখি টিন সরানো। লতিফা চিৎকার করে বলছে—আমার বাচ্চারে কুয়ার ভিতর ফালাইয়া দিছে। আমার বাচ্চা কুয়ার ভিতরে। লতিফা লাফ দিয়া কুয়াতে নামতে চাইল। আমি তাকে জড়ায়ে ধরলাম।
ইমাম সাহের চুপ করে গেলেন। কপালের ঘাম মুছলেন।
আমি বললাম, বাচ্চাটা কি সত্যি কুয়াতে ছিল?
জ্বি।
আর দ্বিতীয় বাচ্চা? সে-ও কি এইভাবে মারা যায়?
জ্বি-না জনাব। আমার দ্বিতীয় বাচ্চা শ্বশুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করে।
সিদ্দিক সাহেবের ঐ বাড়ি তাহলে আপনি ছেড়ে দেন?
জ্বি। তাতে অবশ্য লাভ হয় না। কফিলের যন্ত্রণা কমে না। দ্বিতীয় সন্তানটাকেও সে মারে। জন্মের চারদিনের দিন–
আমি আৎকে উঠে বললাম, থাক ভাই, আমি শুনতে চাই না। গল্পগুলো আমি সহ্য করতে পারছি না।
ইমাম সাহেব বললেন, আল্লাহপাক আরেকটা সন্তান দিতেছেন। কিন্তু এই সন্তানটাকেও বাঁচাতে পারব না। মনটা বড়ই খারাপ ভাই সাহেব। বড়ই খারাপ। আমি কত বার চিৎকার করে বলেছি-কফিল, তুমি আমারে মেরে ফেল। আমার সন্তানরে মের না। এই সুন্দর দুনিয়া তারে দেখতে দাও।
ইমাম সাহেব কাঁদতে লাগলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোর হল! ইমাম সাহেব ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন।
সেইদিন ভোরেই আমি সফিককে নিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। সফিকের আরো কিছুদিন থেকে কালু খাঁর রহস্য ভেদ করে আসার ইচ্ছা ছিল। আমি তা হতে দিলাম না। ইমাম সাহেবের সঙ্গে আরো কিছু সময় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
.
৩.
সাধারণত আমি আমার জীবনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার গল্প মিসির আলির সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্র বলি। মজার ব্যাপার হচ্ছে—ইমাম সাহেরের এই গল্প তাঁকে বলা হল না!
ঢাকায় ফেরার তিন দিনের মাথায় তাঁর সঙ্গে আমার দেখা নানান কথাবার্তা হল-এটা বাদ পড়ে গেল।
দু, মাস পর মিসির আলি আমার বাসায় এলেন। রাতে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করলাম। তিনি প্রায় দু ঘন্টা কাটিয়ে বাড়ি চলে গেলেন—ইমাম সাহেবের গল্প বলা হল না। তিনি চলে যাবার পর মনে হল–ইমাম সাহেবের গল্পটা তো তাঁকে শোনানো হল না।
আমি আমার মেয়েকে বলে রাখলাম যে এর পরে যদি কখনো মিসির আলি সাহেব আমাদের বাসায় আসেন, সে যেন আমার কানের কাছে ইমাম বলে একটা চিৎকার দেয়। আমার এই মেয়ের স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। সে যে যথাসময়ে ইমাম বলে চিৎকার দেবে, সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
হলও তাই। অনেকদিন পর মিসির আলি সাহেব এসেছেন। তাঁর সঙ্গে গল্প করছি।—আমার মেয়ে কানের কাছে এসে বিকট চিৎকার দিল। এমন চিৎকার যে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল! মেয়েকে কড়া ধমক দিলাম। মেয়ে কাদো-কাদো হয়ে বলল, তুমি তো বলেছিলে মিসির চাচু এলে-ইমাম বলে চিৎৎকার করতো।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কানের পর্দা ফাটিয়ে দিতে তো বলি নি। যাও, এখন যাও তো!
মিসির আলি বললেন, ব্যাপারটা কী?
আমি বললাম, তেমন কিছু না। আপনাকে একটা অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাচ্ছিলাম। একজন ইমাম সাহেবের গল্প। আপনার সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু গল্পটা বলার কথা মনে থাকে না! মেয়েকে মনে করিয়ে দিতে বলেছি। সে এমন চিৎকার দিয়েছে, এখন মনে হচ্ছে বা কানে কিছু শুনতে পাচ্ছি না।
মিসির আলি বললেন, গল্পটা কী বলুন শুনি।
আজ থাক। আরেক দিন বলব। একটু সময় লাগবে। লম্বা গল্প।