আল্লাহপাক আমার প্রার্থনা শুনলেন।
ভোরবেলায় চালের আড়তে গিয়েছি। সিদ্দিকুর রহমান সাহেব আমারে ডেকে বললেন, এই যে মৌলানা, আমার একটা উপকার করতে পারবে?
আমি বললাম, জ্বি জনাব, বলেন।
ময়মনসিংহ শহরে আমি নতুন বাড়ি করেছি। এখন থেকে ঐ বাড়িতে থাকব! সপ্তাহে-সপ্তাহে এইখানে আসব। নেত্রকোণায় আমার যে-বাড়ি আছে–তুমি কি এই বাড়িতে থাকতে পারবে? নেত্রকোণার বাড়ি আমি বিক্রি করতে চাই না। শুনলাম তুমি বিবাহ করেছি–তুমি এবং তোমার স্ত্রী দু জন মিলে থাক।
আমি বললাম, জনাব, আমি অবশ্যই থাকব।
তা হলে তুমি এক কাজ কর, আজকেই চলে আস।। একতলার কয়েকটা ঘর নিয়ে তুমি থাক। দোতলার ঘর তালাবন্ধ থাকুক।
জ্বি আচ্ছা! বাড়িটা শহর থেকে দূরে। তবে ভয়ের কিছু নেই, একজন দারোয়ান আছে। চরিশ ঘন্টা থাকবে। দারোয়ানের নাম বলরাম। ভালো লোক।।
জনাব আমি আজকেই উঠব।
সেইদিন বিকালেই সিদিক সাহেবের বাড়িতে গিয়া উঠলাম। বিরাট বাড়ি। বাড়ির নাম সরাজুবালা হাউস। হিন্দু বাড়ি ছিল। সিদ্দিক সাহেবের বাবা কিনে নিয়েছিলেন। আট ইঞ্চি ইটের দেয়ালে বাড়ির চারদিক ঘেরা। দোতলা পাকা দালান। বিরাট বড় বড় বারান্দা। দেয়ালের ভিতরে নানান জাতের গাছগাছড়া দিনের বেলায়ও অন্ধকার হয়ে থাকে।
আমি লতিফাকে বললাম, বাড়ি পছন্দ হয়েছে লতিফা?
লতিফা আনন্দে কেঁদে ফেলল। দুই দিন খাওয়াদাওয়া না-করায় লতিফার শরীর নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চোখ ছোট-ছোট, ঠোঁট কালচে। মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। এই অবস্থাতেই সে রান্নাবান্না করল। অতি সামান্য আয়োজন। ভাত ডাল পেঁপে ভাজা! খেতে অমৃতের মতো লাগল ভাইসাহেব।
খাওয়াদাওয়ার পর দু জনে হাত ধরাধরি করে বাগানে হাঁটলাম। হাসবেন না ভাইসব, তখন আমাদের বয়স ছিল অল্প। মন ছিল অন্য রকম! হাঁটতে-হাঁটতে আমার মনে হল, এই দুনিয়াতে আল্লাহপাক আমার মতো সুখী মানুষ আর তৈরি করেন নাই। আনন্দে বারবার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল ভাই সাহেব!
ক্লান্ত হয়ে একসময় একটা লিচুগাছের নিচে আমরা বসলাম। লতিফ বলল, আমি যে মিথ্যা কথা বইলা আপনেরে বিবাহ করছি, এই জন্য কি আমার উপর রাগ করছেন?
আমি বললাম, না লতিফা। আমার মতো সুখী মানুষ নাই।
যদি সুখী হন তাহলে এই ধাঁধাটা পারেন কি না দেখেন। বলেন দেখি–
কাটলে বাঁচে, না-কাটলে মরে
এমন সুন্দর ফল কোন গাছেতে ধরে?
পারলাম না লতিফা ভালোমতো চিন্তা কইরা বলেন। এইটা পারা দরকার। খুব দরকার–
কাটলে বাঁচে, না-কাটলে মরে
এমন সুন্দর ফল কোন গাছেতে ধরে?
পারব না লতিফ। আমার বুদ্ধি কম।
এইটা হইল সন্তানের নাড়ি-কাটা। সন্তানের জন্মের পর নাড়ি কাটলে সন্তান বাঁচে। না-কাটলে বাঁচে না। আচ্ছা এই ধাঁধাটি আপনেরে কোন জিজ্ঞেস করলাম বলেন তো?
তুমি বল। আমার বিচারবুদ্ধি খুবই কম।
এইটা আপনেরে বললাম—কারণ আমার সন্তান হবে!
লতিফা লজ্জায় দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। কী যে আনন্দ আমার হল ভাইসাহেব-কী যে আনন্দ!
সেই রাতে লতিফার জ্বর আসল।
বেশ ভালো জ্বর। আমি জ্বরের খবর রাখি না! ঘুমাচ্ছি। লতিফা আমারে ডেকে তুলল। বলল, আমার খুব ভয় লাগতেছে, একটু উঠেন তো।
আমি উঠলাম। ঘর অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না। হারিকেন জ্বালায়ে শুয়েছিলাম। বাতাসে নিতে গেছে। হারিকেন জ্বালালাম।
তাকিয়ে দেখি লতিফার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। সে ফিসফিস করে বলল, ছাদের কার্নিশে কে যেন হাঁটে।
আমি শোনার চেষ্টা করলাম। কিছু শুনলাম না।
লতিফা বলল, আমি স্পষ্ট শুনেছি। একবার না, অনেক বার শুনেছি। জুতা পায়ে দিয়া হাঁটে। জুতার শব্দ হয়। হাঁটার শব্দ হয়।
বোধহয় দারোয়ান!
না, দারোয়ান না। অন্য কেউ।
কি করে বুঝলা অন্য কেউ?
বললাম না জুতার শব্দ! দারোয়ান কি জুতা পরে?
তুমি থাক। আমি খোঁজ নিয়া আসি?
না না। এইখানে একা থাকলে আমি মরে যাব।
আমি লতিফার হাত ধরে বসে রইলাম। এই প্রথম বুঝলাম লতিফার খুব জ্বর। জুর আরো বাড়ল। একসময় জ্বর নিয়ে ঘুমায়ে পড়ল। তখন আমি নিজেই শব্দটা শুনলাম। ঝন ঝন শব্দ। জুতার শব্দ না। অন্য রকম শব্দ। ঝন-ঝন ঝনঝন।
একমনে আয়াতুল কুরসি পড়লাম।
তিন বার আয়াতুল কুরসি পড়ে হাততালি দিলে-সেই হাততালির শব্দ যতদূর যায় ততদূর কোনো জিন-ভূত আসে না। হাততালি দেয়ার পর ঝনঝন শব্দ কমে গেল, তবে পুরোপুরি গেল না। আমি সারা রাত জেগে কাটালাম।
ভোরবেলা সব স্বাভাবিক।
রাতে যে এত ভয় পেয়েছিলাম মনেই রইল না। লতিফার গায়েও জ্বর নেই। সে ঘর-দুয়ার গোছাতে শুরু করল। একতলার সর্বদক্ষিণের দুটো ঘর আমরা নিয়েছি। বারান্দা আছে। কাছেই কলঘর। লতিফা নিজের সংসার ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দারোয়ান বলরাম সাহায্য করার জন্য চলে আসল। বলরামের বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। আদি বাড়ি নেপালে। দশ বছর বয়সে বাংলাদেশে এসেছে, আর ফিরে যায় নি। এখন পুরোপুরি বাঙালি। বাঙালি একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিল। সে মেয়ে মরে গেছে। বলরামের এক ছেলে আছে। খুলনার এক ব্যাঙ্কের দারোয়ান। ছেলে বিয়ে-শাদি করেছে। বাবার কোনো খোঁজখবর করে না।
বলরামের সঙ্গে অতি অল্প সময়ে লতিফার ভাব। বলরাম লতিফাকে মা ডাকা শুরু করল। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে দোকানে চলে গেলাম। ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল!