‘মনে হচ্ছে আপনি হতাশ হয়ে গেছেন?’
‘না আলী, নিরাশ হইনি, একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। আলী, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কাছে আমাদের নির্দেশ পৌঁছে দাও। সেনা ভর্তি আরো তীব্রতর কর। যুদ্ধে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সবসময় প্রাধান্য দেবে। সৈন্য ভর্তির বাধ্যতামূলক শর্ত হল ইসলামী আমল আখলাক। শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার দিকে বিশেষ নজর দেবে। ওদেরকে স্পেশাল গেরিলা ট্রেনিং দেবে। শত্রুর এলাকায় গিয়ে কাজ করতে হবে ওদের। ওরা হবে সুইসাইড স্কোয়ার্ড। গেরিলাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কর। ওদের থাকতে হবে উটের মত দীর্ঘসময় ক্ষুঁৎ পিপাসা সহ্য করার শক্তি। দৃষ্টি হবে ঈগলের মত, মরু শিয়ালের মত হবে সতর্ক। চিতাবাঘের মত ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুর ওপর। শক্তি সাহস আর বুদ্ধিমত্তায় হবে অনন্য। মদ হাসিস বা এ জাতীয় মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে ওদের। ওদেরকে মোকাবেলা করতে হবে সেই সব নারীদের। যৌবনের পশরা সাজিয়ে, চোখে মদির নেশা জাগিয়ে যারা আসবে ওদের ছোবল হানতে। এ ব্যাপারগুলো এদের এমন ট্রেনিং দেবে, যেনো নৃত্যরত পরী এলেও ওরা থাকতে পারে বরফশীতল।
ভর্তি আরো তীব্রতর করো আলী। মনে রেখো, আমি আবেগতাড়িত হয়ে কাজ করতে পছন্দ করিনা। সংখ্যায় যত নগন্যই হোক, আমি যোদ্ধা চাই। সেই সব যোদ্ধা, যাদের ভেতরে থাকবে ইসলামী ঐতিহ্য ও চেতনাবোধ। কেন যুদ্ধ করছি এ প্রশ্ন কখনো কারো মনে উদয় হবে না। শুরুথেকেই সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার উদ্দেশ্য কি তা ওদের ভাল করে বুঝিয়ে দাও। এ দুর্দিনে জাতি তাদের কাছে কতটুকু ত্যাগ ও কোরবানী দাবী করে এ কথা প্রত্যেকটি সৈনিকের অন্তরে এমন ভাবে গেঁথে দাও, যাতে এটাকে কেউ কেবল চাকরী মনে না করে।’
নাজি তার ক্ষমতা ও প্রাধান্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে একটি দুঃসাহসিক গোয়েন্দা সংস্থা গড়ে তুলেছিল। ওরা নাজিকে বলল, ‘আলী বিন সুফিয়ান সালাহউদ্দীন আউয়ুবীর বিশেষ উপদেষ্টা এবং গুপ্তচর বৃত্তিতে আরব শ্রেষ্ঠ। আপনার অস্তিত্বের জন্য সে এক মারাত্মক হুমকী স্বরূপ।’
নাজি আলীর পেছনে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছিল। তাদের রিপোর্টের পর সে আলীকে হত্যা করারও পরিকল্পনা করল। সালাহউদ্দীনকে ফাঁসানোর জন্য জুকিকে তৈরী করেছিল নাজি, কিন্তু সে জানতেও পারেনি, নিজেই সে জুকির ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। শুধু অসাধারণ রূপের জৌলুষেই নয়- জুকির মধুমাখা কণ্ঠে ছিল যাদুর ছোঁয়া। ওকে নিজের পাশে বসিয়ে কথা বলত নাজি।
এখন আর পুরনো নর্তকীদের ডাক পড়েনা। ঈর্ষার আগুনে পুড়ে মরতে লাগল ওরা। এ ঈর্ষার আগুন ওদের এতটাই ক্ষিপ্ত করলো যে, পুরনো নর্তকী দু’জন জুকীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করল। কিন্তু কার্যত এ ছিল অসম্ভব। ওর কক্ষের সামনে সারাক্ষণ দু’জন প্রহরী দাঁড়িয়ে থাকত। অন্যদিকে অনুমতি ছাড়া নর্তকীরা বাইরে যেতে পারত না। অনেক ভেবেচিন্তে ওরা হারেমের এক চাকরাণীকে হাত করে নিল।
গভর্ণরের পুরনো বডিগার্ড বদলে দিলেন আলী। সেখানে নিয়োগ করলেন দুঃসাহসী এবং আত্মত্যাগী নতুন সৈন্য। ওদের প্রত্যেকেই ছিল একেকজন আদর্শ সৈনিক। নাজি এ পরিবর্তন মেনে নিতে না পারলেও আইয়ুবীর সামনে তা প্রকাশ করল না। সম্বর্ধনায় হাজির হওয়ার জন্য সে আবার আইয়ুবীকে অনুরোধ করল। আইয়ুবী বললেন, ‘কবে আপনার দাওয়াতে যেতে পারব দু’ একদিনের মধ্যেই আপনাকে তা জানাবো।’
নাজি চলে গেলে তিনি এ ব্যপারে আলীর পরামর্শ চাইলেন। আলী বললেন, ‘যে কোন সময় আপনি নাজির নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারেন।’
পরদিন সালাহউদ্দীন নাজিকে জানালেন, তিনি এখন তার দাওয়াত কবুল করতে প্রস্তুত। নাজি তিন দিন সময় নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করার অনুমতি প্রার্থনা করলে আইয়ুবী সানন্দে তাতে সম্মতি দিলেন।
অনুমতি পেয়ে নাজি আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করল। অনুষ্ঠানটি হবে শহর থেকে দূরে। মশাল জ্বেলে আলোর ব্যবস্থা করা হবে। ব্যবস্থা থাকবে নাচগানের। ঘোড়সওয়াররা তাদের নৈপুণ্য দেখাবে। মশালের আলোয় অনুষ্ঠিত হবে কুস্তি, নেজাবাজি এৰং তলোয়ারের খেলা। রাতে ওখানেই সবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তৈরী করা হয়েছে আলীশান তাঁবু। পুরো অনুষ্ঠানমালা জানানো হল সালাহউদ্দীনকে। তিনি মনযোগ দিয়ে বিস্তারিত কর্মসূচী শুনলেন কিন্তু নাচগান সম্পর্কে কিছুই বললেন না। এতে নাজি উৎফুল্ল হল। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘সেনাবাহিনীর বেশীর ভাগ ফৌজ দুর্বল মুসলিম। ওরা কখনো সখনো মদপান করে, তবে অভ্যস্ত নয়। আপনাকে সম্বর্ধনা জানানোর এ আনন্দঘন অনুষ্ঠানে ওরা সামান্য পদ পানের অনুমতি চাইছে।’
‘এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। আপনি আমাকে দাওয়াত করেছেন, আমি সে দাওয়াত কবুল করেছি। ওখানে আপনি কি করবেন তা আপনিই ভাল বুঝবেন। আপনি ওদের কমাণ্ডার। ইচ্ছে হয় অনুমতি দেবেন, না হয় দেবেন না, আমি এ ব্যাপারে আপনাকে কোন নির্দেশ দেব না।’
‘মিসরের আমীরের জয় হোক।’ আনন্দে গদগদ হয়ে মোসাহেবী কণ্ঠে বলল নাজি। ‘যে কাজ আপনি অপছন্দ করেন না আমি তার অনুমতি দেয়ার কে? নেহায়েত আপনাকে উপলক্ষ করে ওরা একটু আনন্দ করতে চাইছে, নইলে এ প্রস্তাব আমি কিছুতেই উঠাবার দুঃসাহস করতাম না।’