আসর ভেঙে দিল নাজি। নতুন মেয়েটাকে রেখে সকলকে বিদায় করে দিল।
‘নাম কি সুন্দরী?’
‘আমার নাম জুলি’।
‘তোমাকে যে দিয়ে গেল সে বলেছে, তুমি নাকি পাথর গলাতে পার। আমি তোমার সে যোগ্যতা যাচাই করতে চাই। ‘
‘কে সে পাথর?’
‘মিসরের নতুন গভর্নর। যিনি একই সাথে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কও।’
‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী?’
‘হ্যাঁ, যদি তাকে বশে আনতে পার তবে তার ওজন সমান সোনা তোমার পুরস্কার।’
‘তিনি কি মদ পান করেন?’
‘না, মুসলমান শূকরকে যেমন ঘৃণা করে, সে মদ, নারী, নাচ, গান এবং ভোগবিলাশকে তেমনি ঘৃণা করে।’
‘শুনেছি আপনার কাছে এমন সব যুবতী রয়েছে যাদের দেহের যাদু নীল নদের স্রোতকেও রুদ্ধ করে দিতে পারে। ওরা কি ব্যর্থ?’
‘এখনো পরীক্ষা করে দেখিনি। আমার বিশ্বাস তুমি এ কাজ করতে পারবে। সালাহউদ্দীনের বিশ্বাস এবং চরিত্র সম্পর্কে আমি তোমাকে বিস্তারিত বলবো।’
‘তাকে কি বিষ খাওয়াতে হবে?’
‘এখন নয়। তার সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। আমি চাই সে তোমার মত রূপসীর আঁচলে বাঁধা পড়ুক। এরপর তাকে আমার পাশে বসিয়ে মদ খাওয়াব। মারতে চাইলে তোমার প্রয়োজন নেই, ঘাতক দলকে দিয়ে সহজেই তা করানো যায়।’
‘তার মানে আপনি দুশমনি নয় বন্ধুত্ব চাইছেন?’
জুকির বুদ্ধিমত্তায় নাজি কতক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
‘হ্যাঁ জুকি।’
ওর রেশম কোমল চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল নাজি, ‘আমি তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। এমন বন্ধুত্ব, যেন সে আমার কথায় উঠে এবং বসে। এর পর কি করতে হবে তা আমি জানি।’ থামল নাজি।
একটু ভেবে নিয়ে আবার বলল, ‘একটা কথা তোমাকে বলা প্রয়োজন। সালাহউদ্দীনের হাতেও একটা চাল আছে। তোমার রূপ যৌবনের ওপর তার চাল বিজয়ী হলে তুমি বাঁচতে পারবে না। সালাহউদ্দীনও তোমায় বাঁচাতে পারবে না। তোমার জীবন আমার হাতে। এ জন্যই তোমার সাথে এত খোলামেলা কথা বলছি। নইলে আমার মত জেনারেল তোমার মত এক গনিকার সাথে এভাবে আলাপ করত না।’
‘অনাগত ভবিষ্যত বলে দেবে কে ধোঁকা দেয়। এবার বলুন তার কাছে আমি পৌঁছব কিভাবে?’
‘আমি তার সম্মানে এক সংবর্ধনার আয়োজন করতে যাচ্ছি। রাতে তার শয়ন কক্ষে তোমায় ঢুকিয়ে দেব।’
‘ঠিক আছে, এর পরের কাজ হবে আমার।’
সে রাতের পর আরও ক’টা রাত চলে গেছে। প্রশাসনিক কাজ এবং নতুন সৈন্য ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আইয়ুবী নাজির নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি। এর মধ্যেই নাজি সম্পর্কে আলী বিন সুফিয়ানের আরো রিপোর্ট পাওয়া গেল। আলীর সে রিপোর্ট পেয়ে সালাহউদ্দীন চিন্তিত হয়ে উঠলেন।
‘আলী! এর অর্থ হল সে খৃষ্টানদের চাইতেও বিপদজনক।’
‘লোকটা মিসরের পোশাকের ভেতর লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত সাপ। প্রশাসনের অনেক বড় বড় লোক তার হাতে। সেনাবাহিনীও আমাদের নয় বরং অন্যের অনুগত। এ ব্যপারে কি করা যায় কিছু ভেবেছেন?’
‘শুধু ভাবিনি, কাজও শুরু করে দিয়েছি। সুদানী সৈন্যদেরকে নতুন সৈন্যদের সাথে একীভূত করে দেব। এখন এরা না হবে সুদানের, না মিসরের। এপর নাজিকে সোজা পথে নিয়ে আসা যাবে।’
‘আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, সে খৃষ্টানদের সাথে নিজের ভবিষ্যত জুড়ে দিয়েছে। মুসলিম বিশ্বকে এক কেন্দ্রের আওতায় এনে আপনি মুসলিমদের শক্তি বৃদ্ধি করতে চাইছেন। কিন্তু নাজি আপনার ও ইচ্ছেকে পাগলামী মনে করে।’
‘তুমি কি করছ?’
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তার চারপাশে আমি গুপ্তচরের প্রাচীর তৈরী করে দিয়েছি। মনে করুণ সে এখন গোয়েন্দাদের দুর্গে বন্দী। আমি সব বিষয়েই আপনাকে অবহিত করব।’
আলীর ওপর ছিল সালাহউদ্দীনের পূর্ণ আস্থা। তাই তার গোপন তৎপরতা সম্পর্কে কিছুই তাকে জিজ্ঞেস করলেন না।
‘শুনলাম নাজি আপনাকে সংবর্ধনা দিতে চাইছে। যেতে চাইলে আমি যখন বলব তখন যাবেন।’
সালাহউদ্দীন আইয়ুবী কতক্ষণ ঘরময় পায়চারী করলেন। হঠাৎ কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল ব্যথাভরা ‘আহ’ শব্দ। দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। তাকালেন আলী বিন সুফিয়ানের দিকে।
‘আলী, জীবন মৃত্যু তো আল্লাহর হাতে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে বেঁচে থাকার চাইতে জন্মের সাথে সাথেই কি মরে যাওয়া ভাল নয়? কখনো ভাবি, যাদের মাঝে জাতীয় চেতনাবোধ নেই, নেই কোন মহৎ ভাবনা সম্ভবতঃ পৃথিবীতে তারাই সুখী। ওরা নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকে, মরেও যায় তেমনি।
‘না, সম্মানিত আমীর! ওরা সবচেয়ে বেশী হতভাগা।’
‘হ্যাঁ আলী। আমি যখন ওদেরকে ভাগ্যবান মনে করি কে যেন আমার কানের কাছে এসে তোমার কথাটাই উচ্চারণ করে যায়। মনে রেখো আলী, ইতিহাসের বর্তমান ধারা পরিবর্তন করতে না পারলে মুসলিম বিশ্ব হারিয়ে যাবে উপত্যকা আর মরুভূমির সীমাহীন বিস্তারে। খেলাফত এখন তিন ভাগে বিভক্ত। আমীর ওমরার দল স্বেচ্ছাচারী, খৃস্টান ষড়যন্ত্রের আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে ওরা। আমার আশংকা হচ্ছে, মুসলমানরা বেঁচে থাকলেও থাকবে খৃষ্টানদের গোলামীর শৃংখলিত। শুধু বেঁচে থেকেই সন্তুষ্ট থাকবে ওরা। জাতিসত্ত্বা বলে কিছুই থাকবে না, যেন সে শুধু এক মৃতের কফিন। দেখছো না, অর্ধশতাব্দীর মধ্যেই আমাদের মানচিত্র কতো সংকীর্ণ হয়ে এসেছে!’
মাথা নুইয়ে আবার তিনি পায়চারী করতে লাগলেন। কুঞ্চিত কপালে চিন্তার ভাজ। এক সময় মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে গমগম কণ্ঠে বললেন, ‘আলী, নিজের ভেতর থেকে ধ্বংস শুরু হলে তা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের খেলাফত এবং আমীরগণ বর্তমান অবস্থায় থাকলে খৃষ্টানদের আক্রমণ করার প্রয়োজনই পড়বে না। যে আগুন আমাদের ঈমান, আমাদের কর্ম আর জাতিসত্ত্বাকে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে খৃস্টানরা তাতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে মাত্র। ওদের ষড়যন্ত্র আমাদেরকে একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে বাধ্য করছে। হয়তো আমার ইচ্ছে অপূর্ণই থেকে যাবে। আমি পরাজিত হতে পারি, তবুও জাতির কাছে আমি কিছু কথা রখে যেতে চাই। আমি চিৎকার করে বলতে চাই, অমুসলিমকে কখনো বিশ্বাস করো না। যুদ্ধ করতে করতে জীবন দেবে, তবু দুশমনের পাতা ফাঁদে পা দেবে না।’