অভিভুত হয়ে সুলতানের কথা শুনছিল মারইউস। তিনি বললনে, ‘আমার খোদাকে গ্রহণ করতে হয় খাঁটি মনে। অন্তর পরিচ্ছন্ন না হলে তিনি তার ফরিয়াদ শোনবেন কেন? তুমি ন্যায়বিচার চাইলে আগে নিজের অন্তর পরিষ্কার কর।’
সুলতান খঞ্জর ছুঁড়ে দিলেন তার দিকে। তার সামনে গিয়ে পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মুবি! ওকে বল, আমার জীবন তার হাতে তুলে দিলাম। এ খঞ্জর আমার পিঠে বিদ্ধ করুক।’
খঞ্জর হাতে তুলে নিল মেগনামা মারইউস। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখল। তাকাল সুলতানের পিঠের দিকে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর চলে এল সুলতানের সামনে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সুলতানকে। চোখে চোখ রাখল। কেঁপে গেল তার হাত। সত্য খোদাকে দেখছে ও।
হাঁটু গেড়ে সুলতানের পায়ের কাছে খঞ্জর রাখল মারইউস। চুমো খেল সুলতানের হাতে। তার চোখ ফেটে বেরিয়ে এল অশ্রুর বন্যা। মুবির দিকে তাকিে বলল, ‘এই কি খোদা! নাকি খোদাকে এ বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছেন। তার খোদাকে দেখাতে বল।’
সুলতান দুবাহু ধরে তাকে তুললেন, জড়িয়ে ধরলেন বুকের সাথে। নিজের হাতে মুছে দিলেন তার অশ্রু।
মেগনামা মারইউস। এক পথহারা পথিক। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তার হৃদয়ে। পরিস্থিতি তাকে তার স্বাভাবিক জীবন থেকে সরিয়ে এনে তাকে করে তুলেছিল প্রতিশোধ পরায়ন ও বিকারগ্রস্থ। তার পাগলাটে স্বভাব বা আবেগ বিপজ্জনক অভিযানে নিয়ে এসেছিল তাকে।
সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর চোখে ও নিরপরাধ। কিন্তু ছাড়তেও পারছিলেন না। কারণ তার সাথে আছে ট্রেনিংপ্রাপ্ত বিপজ্জনক ফেরারী গুপ্তচর মুবি। খৃষ্টানদের সংবাদ সুদানীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে সে। উস্কানি দিয়েছে বিদ্রোহের জন্য। ও দেশ এবং জাতির শত্রু। আইন তাকে ক্ষমা করতে পারে না।
তাদের দু’জনকেই আলীর হাতে তুলে দেয়া হল। জবানবন্দিতে অপরাধ স্বীকার করল ওরা। স্বীকার করল রসদবাহী কাফেলা লুণ্ঠন করার কথা। প্রহরীদের হত্যা করে মেয়েদের ছাড়িয়ে নেয়ার কথাও বলল।
জিজ্ঞাসাবাদ চলল তিন দিন। এর মধ্যে মারইউসের চিন্তাধারা অনেকটা পরিচ্ছন্ন হয়েছে। আলাদা আলাদা ভাবে চলছে ওদের জিজ্ঞাসাবাদ। একবার ও জিজ্ঞেস করল, ‘মেয়েটা কোথায়? ওকে মুসলমান করে সুলতান কি তাকে হারেমে অন্তর্ভূক্ত করেছেন?’
‘আজ সন্ধ্যায় এর জবাব পাবে।’
সন্ধ্যায় মারইউসকে এক দেয়াল ঘেরা চত্বরে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে চাদরে ঢাকা দুটো তক্তপোষ। একদিক থেকে চাদর তুলে ফেলা হল। আতংকে বিবর্ণ হয়ে গেল মারইউসের চেহারা। একটা মুবির অন্যটায় তার সংগী। মৃত। ওদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী বললেন, ‘এদের ক্ষমা করা যায় না। মুসলিম মিল্লাতের কত ক্ষতি করেছে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।’
‘সুলতান, আমায় কেন ক্ষমা করলেন?’
‘কারণ, তুমি এসেছিলে আমাকে হত্যা করতে। ওরা এসেছে আমার জাতিসত্ত্বাকে ধ্বংস করতে। তোমার সংগী বুঝে সুঝে এ দলের সংগী হয়েছে। হত্যা করেছে অনেক লোক। তুমি শুধু আমাকে মেরেই খোদাকে দেখতে চেয়েছ। ফলে তোমায় আমি ক্ষমা করতে পারলেও ওদের ক্ষমা করার সাধ্য আমার নেই।
কিছুদিন পর। মেগনামা মারইউস এখন সাইফুল্লাহ। তাকে সুলতানের দেহরক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত করা হল। ইতিহাসে তার নাম না থাকলেও বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের ডায়েরীতে সাইফুল্লার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আরবী ভাষায় লিখিত এ ডায়েরী আজও অক্ষত আছে।
সাইফুল্লাহ সুলতানকে ভালবাসত প্রাণের চেয়ে বেশী। সুলতানের মৃত্যুর পরও সতের বছর বেঁচেছিল সাইফুল্লাহ। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর মৃত্যুর পর সে ছিল সুলতানের কবরের খাদেম।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কবর ছেড়ে সে যায়নি কোথাও। মরার আগে ওসিয়ত করে গিয়েছিল, মৃত্যুর পর যেন সুলতানের কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হয়। সে কবরস্তান আজ কালের প্রবাহে হারিয়ে গেছে, কিন্তু হারিয়ে যায়নি সুলতানের জন্য তার ভালবাসার কাহিনী।
* * *