একটু থেমে লজ্জাজড়িত কণ্ঠে যুবতী আবার বলল, ‘মহামান্য সুলতান! জানি, আমি আপনার উপযুক্ত নই। এ প্রস্তাব করার দুঃসাহসও আমার নেই যে আপনি আমায় বিয়ে করুন। আমার রূপ যৌবনই আমার শত্রু। এ রূপ নিয়ে কোথাও একাকী জীবন কাটানো আমার জন্য নিরাপদ নয়। আপনার হারেমের বাদী হতে পারলেও আমার জীবনকে ধন্য মনে করতাম।’
মেয়েটি পুরুষ সংগীর কাঁধে একহাত এবং নিজের বুকে এক হাত রেখে সুলতানের দিকে ইশারা করল। পুরুষটি হাত জোড় করে সুলতানের সামনে এগিয়ে এল। সে বোঝাতে চাইছে, ‘সুলতান! আমার এ মেয়েটাকে গ্রহণ করুন।’
‘আমার কোন হারেম নেই। দেশের সব হারেম, পতিতাপল্লী এবং মদপান আমি বন্ধ করে দিয়েছি।’
কথা বলতে বলতে তিনি পকেট থেকে একটা মুদ্রা বের করে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। ‘আমি নারীর ইজ্জতের রক্ষক হতে চাই।’
পায়চারী করতে করতে তিনি ওদের পেছনে চলে এলেন। মুদ্রা হাত থেকে ছেড়ে দিলেন। ঝন করে শব্দ হল। পুরুষটি চমকে পেছনে তাকাল।
সুলতান দ্রুত খাপ থেকে খঞ্জর টেনে পুরুষটির ঘাড়ে ঠেকিয়ে যুবতীকে বললেন, ‘ও আমার ভাষা বোঝে না। ওকে অস্ত্র ফেলে দিতে বল। দেরী হলে তোমার দু’জনই মারা পড়বে।’
ফ্যাকাসে হয়ে গেল যুবতীর চেহারা। বলল, ‘বাবাকে ভয় দেখিয়ে আমায় হাতে নিতে চাইছেন? আমি তো স্বেচ্ছায় নিজকে আপনার কাছে সমর্পণ করতে চাইছি।’
‘যখন তুমি সাগর পারের ছাউনিতে এসেছিলে তখন আরবী জানতে না। এত শীঘ্র এ ভাষা শিখে ফেললে? ওকে অস্ত্র ফেলে দিতে বল।’
যুবতী নিজের ভাষায় পুরুষ সংগীকে অস্ত্র ফেলে দিতে বলল। জুব্বার ভেতর থেকে খঞ্জর বের করে সুলতানের হাতে তুলে দিল লোকটি। ওটা হাতে নিয়ে সুলতান পুরুষটির ঘাড় থেকে খঞ্জর সরিয়ে বললেন, ‘অন্য মেয়েরা কোথায়?’
‘আপনি ভুল করছেন সুলতান।’ কাঁপা কণ্ঠে বলল যুবতী, ‘আমার সাথে আর কোন মেয়ে নেই। আপনি কাদের কথা বলছেন?’
‘আমি অন্ধ নই মেয়ে। একবার যাকে দেখি, কখনও তার চেহারা ভুলি না। যদিও অর্ধেক চেহারা ঢেকে রেখেছ নেকাবে, তবু তোমাকে চিনতে আমার মোটও ভুল হয়নি। যে কাজের জন্য এসেছ তোমরা তুমি তার যোগ্য নও। সরাইখানায় ছিলে স্বামী-স্ত্রী, এখানে পিতা-কন্যা। গোয়েন্দাদের এত আনাড়ি হলে চলে না। তোমাদের চাকরও ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে গেছে।’
মারইউস আইয়ুবীর কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। সুলতান কি বলছে বুঝার জন্য সে মুবির দিকে তাকিয়ে রইল। সুলতান বললেন, ‘ওকে বল, আমার জীবন খৃস্টানদের ঈশ্বরের হাতে নয়, আমার খোদার হাতে।’
মুবি ইটালীর ভাষায় তাকে সুলতানের কথাটা বুঝিয়ে দিল। জবাবে সে কি বলল সুলতান তা বুঝতে পারলেন না। মুবি বলল, ‘সুলতান! ও বলছে আপনার খোদা কি অন্য কেউ, মুসলমান কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে?’
সুলতান বললেন, ‘ওকে বল মুসলমানরা এক সত্য খোদাকে বিশ্বাস করে, তিনি সত্যবাদীকে ভালবাসেন। তোমরা আমাকে হত্যা করার জন্য এসেছ এ কথা আমাকে কে বলল? আমার খোদা। তোমাদের খোদা সত্য হলে এতক্ষণে তোমাদের খঞ্জর আমার বুক এফোঁড় ওফোড় করে দিত। আমার খোদা তোমাদের খঞ্জর আমার হাতে তুলে দিয়েছেন।’
একটা তরবারী এবং কিছু জিনিস বের করে সুলতান বললেন, ‘এগুলো তোমাদের, সাগরের ওপার থেকে নিয়ে এসেছ। অথচ তোমারা এখানে আসার পূর্বেই এগুলো আমার হাতে এসে গেছে।’
দোভাষীর কাজ করছিল মেয়েটা। সে সুলতানের কথা মারউইসকে বুঝিয়ে দিল। আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মারইউস। বিস্ময় বিস্ফারিত চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে বলতে লাগল, ‘লোকটাকে সত্য মনে হয়। এসেছি তাকে হত্যা করতে, এখন আমার জীবন তার হাতে। মুবি, তার বুকের ভেতরে এক খোদাকে আমায় দেখাতে বল। আমি তাকে হত্যা করতে এসেছি, এ সংবাদ যে তাকে দিয়েছে সে খোদাকে আমি দেখতে চাই।’
দীর্ঘ আলাপ করার সময় সুলতানের ছিল না। দু’জনকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তাঁর মনে হল লোকটা পাগল না হলেও মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত। তিনি বন্ধুর মতো কথা বলতে লাগলেন। কি হচ্ছে দেখার জন্য ভেতরে ঢুকলেন আলী। সুলতান মৃদু হেসে বললেন, ‘কোন সমস্যা নেই আলী। খঞ্জর নিয়ে নিয়েছি।’
আলী বেরিয়ে গেল। মারইউস বলল, ‘সুলতান! আমাকে হত্যা করার পূর্বে আপনাকে আমার জীবন কাহিনী শোনাতে চাই।’
অনুমতি পেয়ে সে তার কাহিনী সুলতানকে শোনাল। খৃস্টান কাফেলার সামনে যা বলেছিল হুবহু তাই। যীশু এবং মেরির মূর্তি কথা বলেনি, গির্জায় যেতে পাদ্রীর অনুমতি প্রয়োজন, এতে তার মন ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। সে বলল, ‘মৃত্যুর পূর্বে খোদাকে এক নজর দেখতে চাই সুলতান। আমার ঈশ্বর আমার শিশুদের অনাহারে মেরেছে। আমার মাকে অন্ধ করেছে। একমাত্র যুবতী বোনকে তুলে দিয়েছে মদ্যপ জানোয়াের হাতে। বিনা অপরাধে আমাকে দিয়েছে ত্রিশ বছরের কারাদণ্ড। আমার ফাঁসির জন্য আমার নামে মিথ্যা খুনের দোষ চাপানোর সুযোগ দিয়েছে আমার শত্রুকে। মৃত্যুর মুখোমুখি করে ওখান থেকে বের করে এনেছে আপনাকে হত্যা করার জন্য। সুলতান, এখন আপনার হাতে আমার জীবন। আমাকে সত্য খোদা দেখান। তার কাছে আমার নালিশ জানাবো, ন্যায় বিচার চাইব আমি তার কাছে।’
‘তোমার জীবন আমার হাতে নয়, আমার খোদার হাতে। এতক্ষণে তুমি থাকতে জল্লাদের কাছে। আমি তোমায় সে সত্য খোদাকে দেখাব যিনি তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন।’