তিনি জানতেন তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এ জন্য কখনও তাকে উৎকণ্ঠিত দেখা যায়নি। তিনি বলতেন, ‘আমার জীবন আল্লাহর হাতে। এ ভূখণ্ডে আমার প্রয়োজন না হলে তিনি তুলে নেবেন।’
এজন্য নিজেকে রক্ষার জন্য তিনি চিন্তিত হননি কখনও। প্রশাসন তাঁর চারপাশে গুপ্তচর ছড়িয়ে রেখেছিল। আলী ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক, আইয়ুবীকে তিনি তার মুর্শিদ মনে করতেন।
একদিন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী অফিসার এবং কমাণ্ডারদের বিভিন্ন কাজের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। হেড কোয়ার্টারের গেটে দু’টো ঘোড়া এসে থামল। আরোহীদের একজন মধ্য বয়সী পুরুষ, অন্যজন যুবতী।
ভেতরে ঢুকতে বাঁধা দিল সেন্ট্রিরা। ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল আরোহী দু’জন। যুবতী এগিয়ে এসে কমাণ্ডারকে বলল, ‘আমার পিতা। সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’
কমাণ্ডার পুরুষ আরোহীকে সুলতানের সাথে দেখা করার কারণ জিজ্ঞেস করল। না শোনার ভান করল সে।
যুবতী বলল, ‘বাবা বধীর। কানেও শোনেন না।’
‘কি জন্য দেখা করতে চাচ্ছেন?’
‘সে কথা আমরা সুলতানকে বলব।’
বাইরে পায়চারী করছিলেন আলী বিন সুফিয়ান। এগিয়ে এলেন তিনি। সালাম দিলেন। জবাব দিল যুবতী।
কমাণ্ডার বলল, ‘এরা সুলতানের সাথে দেখা করতে চাইছেন।’
আলী পুরুষটিকে সাক্ষাতের কারণ জিজ্ঞেস করলনে। যুবতী বলল, ‘আমার পিতা বধির। কানেও শোনেন না।’
‘সুলতান ভীষণ ব্যস্ত। সুলতানের সাথে দেখা না করেও আপনাদের সাক্ষাতের উদ্দেশ্য পুরণ হতে পারে। ছোট খাট অভিযোগগুলো সুলতানের কাছে বলার দরকার কি? এজন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে।’
‘এক নির্যাতিতা মুসলিম মেয়ের ফরিয়াদ শোনার সময় কি সুলতানের হবে না? আমার যা বলার তাকেই বলব।’
‘আমাকে বলুন। আমিই আপনাদের ফরিয়াদ সুলতানের কাছে পৌঁছে দেব। প্রয়োজন মনে করলে তিনি আপনাদের ডেকে পাঠাবেন।’
আলী ওদের নিজের কক্ষে নিয়ে গেলেন।
যুবতী বলতে লাগল, ‘উত্তর সীমান্তে আমাদের বাস। বছর দু’য়েক আগে সুদানী ফৌজ সে এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল, অন্য মেয়েদের সাথে আমিও সৈন্যদের দেখার জন্য বেরিয়ে এলাম। এক কমাণ্ডার ঘোড়া ঘুরিয়ে আমার কাছে এল। নাম এবং পরিচয় জানতে চাইল। নাম বললাম। ও আব্বাকে ডেকে আনল। আড়ালে নিয়ে কি যেন জিজ্ঞেস করল। কেউ একজন বলল সে কথা বলতে পারেনা। কমাণ্ডার ফিরে গেল।
সন্ধ্যার পর চারজন সিপাই এসে আমায় জোর করে ধরে নিয়ে গেল। কমাণ্ডারের নাম বালিয়ান। আমি তার হারেমে অন্তরীণ হলাম। ওখানে আরও চারটি মেয়ে ছিল। কামাণ্ডারকে বললাম আমাকে বিয়ে কর। কিন্তু বিয়ে ছাড়াই সে আমায় ভোগ করতে লাগল।
দু’বছর ছিলাম তার কাছে। সুদানীরা বিদ্রোহ করে পরাজিত হল। পালিয়ে গেল বালিয়ান। জানিনা মারা গেছে না বন্দী হয়েছে।
আপনার সৈন্যরা তার বাড়ীতে গিয়ে আমাদের মুক্ত করে দিল। আমি বাড়ী গেলাম। বাবা আমায় বিয়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু কেউ আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলনা। বলল, ‘আমি হারেমের বেশ্যা।’
ওখানে আমার থাকাটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল। আমরা একটা সরাইখানায় উঠেছি। শুনেছি সুলতান সুদানীদের জমি এবং বাড়ী দিচ্ছেন। বালিয়ানের রক্ষিতা বা স্ত্রী মনে করে তিনি যদি আমাকে কিছু জমি দেন তাহলে ওখান থেকে চলে আসব। তা না হল হয় আত্মহত্যা করব নয়তো হবো বারবনিতা।’
‘সুলতানের সাথে দেখা করা ছাড়াই যদি জমি পেয়ে যান তবে কি তাঁর সাথে সাক্ষাতের প্রয়োজন আছে?’
‘হ্যাঁ, আমার শ্রদ্ধা এবং আবেগ তাকে জানানো দরকার। আমি শুধু তাকে বলব, আপনার দেশে নারীরা পুরুষের ভোগের সামগ্রী। আমীর ওমরা এবং বিত্তশালীদের মধ্যে বিয়ের প্রথা ভেঙে গেছে। মেয়েদের ইজ্জত রক্ষা করুন। ওদের সম্মান ওদের ফিরিয়ে দিন। সুলতানকে একথা বলতে পারলে হয়ত আমি মনে শান্তি পাব।’
পুরুষ সংগীটি নির্বাক বসেছিল।
‘আপনারা অপেক্ষা করুন। মিটিং শেষ হলে আপনাদের ডেকে পাঠাব।’ বেরিয়ে গেলেন আলী।
সরাইখানায় গিয়ে ওদের কক্ষ তল্লাশী নিলেন তিনি। লোকদের জিজ্ঞেস করে জানলেন ওরা স্বামী-স্ত্রী। ওরা কি কি কিনেছে তাও তাকে বলা হল। আলী নিশ্চিত হলেন, এরা খৃস্টানদের গুপ্তচর।
ফিরে এসে চাকরটাকে বন্দী করে জেরা শুরু করলেন। জেরার জবাবে সে বলল, ‘মেয়েটা মুবি। পুরুষ সংগীটির নাম মেগনামা মারইউস।’
আলী ফিরে এলেন মুবিদের কাছে। বললেন, ‘আরেকটু বসুন, আমি সুলতানের অনুমতি নিতে যাচ্ছি।’
সুলতানের কক্ষে আলীর অনেক সময় কাটল। তিনি বিস্তারিত জানালেন সুলতানকে। ফিরে এসে যুবতীকে বললেন, ‘সুলতান অনুমতি দিয়েছেন। আপনার পিতাকে নিয়ে আসুন।
আলী ওদেরকে সুলতানের কক্ষ দেখিয়ে দিলেন।
‘ধন্যবাদ’ বলে ওরা প্রবেশ করল ভেতরে। ঢোকার আগে চারদিক নজর বুলিয়ে বাইরেটা দেখে নিল ভাল করে।
ওরা ভেতরে ঢুকলে সুলতান ওদের বসালেন। হাসিমুখে বললেন, ‘বলুন, আপনাদের জন্য কি করতে পারি।’
কক্ষে সুলতান একা। যুবতীকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার পিতা কি জন্ম থেকেই বধির?’
সুলতান বসেননি, কক্ষে পায়চারি করতে করতে বললেন, তোমাদের অভিযোগ আমি শুনেছি। আমি তোমাদের ব্যাথায় সমান ভাবে ব্যথিত। তোমাদেরকে জমি এবং বাড়ী দেয়া হবে। শুনলাম তুমি নাকি আরো কিছু বলতে চাইছ।’
‘দীর্ঘজীবী হোন সুলতান! নিশ্চয়ই শুনেছেন কেউ আমাকে বিয়ে করতে চাইছে না। আমাকে বলছে হারেমের বেশ্যা। বাবাকে বলছে মেয়ে বিক্রেতা! জমি এবং বাড়ী তো দেবেন। কিন্তু শূণ্য বাড়ী দিয়ে আমি কি করবো? আমার কি এমন লোকের প্রয়োজন নয়, যে আমার ইজ্জতের হেফাজত করবে?’