পাহাড়ের ওপর উঠে এর লোকটি। শুয়ে সামনে তাকাল। পেছনের সরে এসে সংগীদের ইশারা করল। ঘোড়া থেকে নেমে উপড়ে উঠে এল সবাই।
কমাণ্ডার সবার সামনে। বেলাভূমির দিকে তাকিয়ে একজনর দেখেই দ্রুত সরে এল সংগীদের কাছে। হুকুম দিল দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার।
ওপাশ থেকে ভেসে আসছিল ঘোড়ার হ্রোষা ধ্বনি। এখানেই সাগর থেকে একটা খাল ভেতরে ঢুকেছে। খৃষ্টানরা লুকিয়ে রাখা নৌকায় উঠছিল। অনেক বড়ো নৌকা। মেয়েরা উঠে পড়েছে। উঠছে বাকীরাও। ঘোড়াগুলো ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
হঠাৎ তীর বৃষ্টি শুরু হল। কমাণ্ডার সকলকে হত্যা না করে জীবন্ত ধরতে চাচ্ছিল। লাফিয়ে যারা নৌকায় চড়তে পেরেছিল তারা দাঁড় টানতে শুরু করল। যারা উঠতে পারল না তারা তীরের আঘাতে নিহত হল।
চওড়া খাল বেয়ে নৌকা চলছে। কমাণ্ডার ওদের ভয় দেখাল, কিন্তু নৌকা থামল না। তীর বৃষ্টি হল একবার, দু’বার, তিনবার। নৌকা লাশে ভরে গেল। ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা কিনারে এসে ঠেকল। ধরে ফেলল সওয়াররা। কেউ বেঁচে নেই। কারো গায়ে দু’টো তীরও লেগেছে।
নৌকা বেঁধে কাফেলা এগিয়ে চলল ছাউনির দিকে। সাগর পারের সেনা ছাউনি এখান থেকে বেশী দূরে নয়।
মিসরের এক সরাইখানায় অবস্থান করছিল মেগনামা মারইউস। সরাইখানায় দু’টো ভাগ। একভাগ সাধারণ পথচারীদের জন্য। অন্যভাগে থাকেন বড় লোক এবং আমীর ওমরার দল। ব্যবসায়ীরাও এ ভাগেই থাকেন। এখানে মদ এবং নর্তকীর ব্যবস্থা আছে। মারইউস এখানে এসে উঠল।
মুবি এখন তার স্ত্রী। সংগীটি বিশ্বস্ত চাকর। মুবির অনবদ্য রূপ সরাইখানায় মারইউসের মর্যাদা বাড়িয়ে দিল। এমন সুন্দরী স্ত্রী যার ঘরে সে নিশ্চয় অনেক বড়লোক। সরাইখানার লোকেরা তার বিশেষ যত্ন নিতে লাগল।
নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিল মুবি। ওদের কাছ থেকে সুলতান আইয়ুবীর অফিস এবং বাড়ীর ঠিকানা জেনে নিল। সুদানীরা পরাজিত এবং সুলতান তাদের ক্ষমা করেছেন এ খবরও পেল সে। আরও শুনল সুদানী কমাণ্ডারদের হারেম এবং যুবতী শূন্য। সুলতান আইয়ুবী তাদের মধ্যে কৃষি জমি বিতরণ করছেন।
মিসরের ভাষা জানে না মারইউস। শাসকদের কাছে পৌঁছার ট্রেনিংও পায়নি সে। মানসিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত। এসেছে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে হত্যা করার বিপজ্জনক মিশন নিয়ে। তার চারপাশে থাকে সশস্ত্র প্রহরা। পাহারার দেয়াল ভেদ করে তার কাছে পৌছা সহজ নয়। কমাণ্ডার তাকে পাগল বলেছেন। বস্তুত সে পাগলই। পৃথিবীর তাবৎ নামী লোকদের হত্যাকারীদের সবাই ছিল আধ পাগল, নয়তো ছিল মানসিকভাবে বিকৃত।
মারইউসও এদেরই একজন। তার কাছে আছে একটা শক্তিশালী অস্ত্র- মুবি। আরবী ভাষা, সভ্যতা সংস্কৃতির ওপর তাকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল। ও জানত মুসলমানদের মনমানসিকতা, অভ্যাস ও চালচলন। গুপ্তচরবৃত্তি এবং অভিনয়ে পারদর্শী মুবি পুরুষ নাচাত চোখের ইশারায়। প্রয়োজনে বিবস্ত দেহ তুলে ধরত পুরুষের কাছে।
সরাইখানার বন্ধ কক্ষে কেটে গেল তিনদিন। ভেতরে তিনজন। মুবি, মারইউস এবং সংগীটি। কেউ জানেনা কি করছে ওরা। দু’টো ঘোড়া এবং কিছু কাপড় কিনেছিল সরাইখানার লোকদের মাধ্যমে। চার দিন পর বেরিয়ে এল মারইউস। সুন্দর করে আঁচড়ানো দাঁড়ি। সুদানীদের মত গাঢ় বাদামী গায়ের রং। পরনে সাধারণ জুব্বা, মাথায় পাগড়ি।
মুবির দেহ কাল বোরকায় ঢাকা। চোখ, কপাল এবং নাক উন্মুক্ত। ঠোঁটের ওপর থেকে ফিনফিনে নেকাব ঝুলানো। তার চোখ ধাঁধানো রূপে চোখ আটকে যায়। সংগীটির নগন্য পোশাক। চাকরদের মত। বাইরে এসে একটা ঘোড়ায় চাপল মারইউস, অন্যটায় মুবি। চাকরের মত তাদের পেছনে চলল সংগীটি।
জংগীর পাঠানো সৈন্যদের সাথে নিয়ে জেরুজালেম আক্রমণ করবে সালাহউদ্দীন, তার আগেই কাজ শেষ করতে চায় ওরা।
অভিযানের পূর্বে সুদানীদের জমি দিয়ে পূনর্বাসন করতে চাইছেন সুলতান। কাজে জড়িয়ে গেলে বিদ্রোহ করার সুযোগ পাবে না ওরা।
সেনাবাহিনীর সংস্কার এবং পূনর্বাসনের কাজ ততোটা সহজ নয়। প্রশাসন এবং ফৌজে সুলতানের বিরোধী লোক ছিল। সুদানীরা আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুযায়ী এখনও তাদের ভেতরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে।
প্রশাসন এবং ফোজের কিছু লোক সুদানীদের পরাজয়ের চেয়ে খৃস্টানদের পরাজয়ে কষ্ট পেয়েছে বেশী। ওরা ভেবেছিল সালাহউদ্দীন আইয়ুবী নিহত হবে। সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে যাবে ওদের জন্য।
এরা বিশ্বাসঘাতক জেনেও সুলতান এদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেননি। কখনো প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেননি। ভাল ব্যবহার করেছেন ওদের সাথে। প্রায়ই বলতেন, ‘কাউকে নিজের ঈমান বিক্রি করতে দেখলে বাঁধা দিও। তাকে বলো সে মুসলমান। তার সাথে মুসলমান বন্ধুর মত ব্যবহার করো।’
কিন্তু আলীর গোয়েন্দারা নিয়মিত ওদের তৎপরতার সংবাদ পৌঁছে দিত সুলতানের কাছে।
রসদবাহী কাফেলা লুণ্ঠিত হয়েছে, প্রহরীদের হত্যা করে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বন্দীদের। এতে বোঝা যায়, সমগ্র মিসরে ওদের কমাণ্ডো বাহিনী ছড়িয়ে আছে। তাদের আশ্রয় দিচ্ছে বিশ্বাসঘাতকরা।
গোয়েন্দা বিভাগকে আরও সম্প্রসারিত এবং শক্তিশালী করার নির্দেশ দিলেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী।
মুসলিম বিশ্বকে শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তিনি। অথচ তার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডব। এজন্য তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন। কি করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন তিনি? মুসলমানের তলোয়ারই স্বজাতির কণ্ঠে ধরা। দিন দিন বিশ্বাসঘাতকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে ছড়ানো ষড়যন্ত্রের জালে ফেঁসে যাচ্ছে ওরা। টাকা এবং নারী সব তছনছ করে দিচ্ছে।