‘কি করতে হবে সে সিদ্ধান্ত আমি দেব।’কমাণ্ডার বলল, ‘তোমাদের কর্তব্য হল আমার নির্দেশ পালন করা।’
‘আমি কারও হুকুম পালন করতে বাধ্য নই। আমরা সবাই ঈশ্বরের আজ্ঞাবহ।’
কমাণ্ডার তাকে ধমকাতে লাগল। মেগনামা মারইউস তরবারী কোষমুক্ত করে কমাণ্ডারের মাথার ওপর তুলতেই অন্যরা মাঝখানে এসে দাঁড়াল।
‘আমি পাপী, অভিশপ্ত। পাপ এবং অবিচারের মাঝে ধুঁকে ধুঁকে মরছিলাম। তোরা কি জান আমার ত্রিশ বছরের শাস্তি কেন হয়েছিল?
পাঁচ বছর পূর্বে আমর এক যুবতী বোনকে অপহরণ করা হয়েছিল। ষোড়শী। আমি দরীদ্র। পিতা নেই, মা অন্ধ। সন্তানরা অবুঝ শিশু। গতর খেটে জীবিকা নির্বাহ করি। গির্জায় যীশুর মূর্তির কাছে অনেক দিন প্রশ্ন করেছিলাম, কেন আমি গরীব? কোন পাপ তো আমি করেনি! আন্তরিকতার সাথে পরিশ্রম করেও কেন ভূখা থাকি। আমার মা কেন অন্ধ? যীশু কোন জবাব দেননি। বোন অপহরণ হবার পর গির্জায় গিয়েছিলাম। মা মেরিকে প্রশ্ন করেছি, আমার বোনের ওপর তুমি এত ক্রুদ্ধ কেন! ও তো নিষ্পাপ। ওকে রূপ দিয়ে ঈশ্বরই জুলুম করেছেন। যীশুর মত মেরিও কোন জবাব দেয়নি।
একদিন এক আমীরের চাকর বলল, ‘তোমার বোন এক আমীরের ঘরে। আমীরটা বদমাশ। সুন্দরী মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। কয়েকদিন আমোদ স্ফুর্তি করে। স্বাদ ফুরিয়ে গেলে গায়েব করে দেয়।
তার উঠাবসা রাজা বাদশার সাথে। মানুষ তাকে সমীহ করে, আইন তার হাতে বন্দী। আমি তার কাছে আমার বোনকে ফেরৎ চাইলাম। গলা ধাক্কা দিয়ে মহল থেকে বের করে দিল আমাকে। আবার গির্জায় গেলাম। যীশু এবং মেরীর মূর্তির সামনে কাঁদলাম। ঈশ্বরকে ডাকলাম। কেউ সাড়া দিল না। আমি গির্জায় একা ছিলাম। পাদ্রী এল, বের করে দিল ঘাড় ধাক্কা দিয়ে। বলল, ‘এখান থেকে মূর্তি চুরি হয়েছে। ভাগ, নইলে পুলিশের হাতে তুলে দেব।’
আমি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘এটা কি ঈশ্বরের ঘর নয়?’
সে বলল, ‘আমার কাছে না বলে ঈশ্বরের ঘরে আসার সাহস তোকে কে দিয়েছে? পাপের স্খলন চাইলে আমার কাছে আয়। পাপের বর্ণনা দে। আমি ঈশ্বরকে বললে তিনি তোকে ক্ষমা করে দেবেন। তুই সরাসরি ঈশ্বরে সাথে কোন কথা বলতে পারিস না। ভাগ এখান থেকে।’ বন্ধুরা! এরপর খোদার ঘর থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হল।
তার বলার ভংগীতে মরু রাতের নিথর প্রকৃতি বিষন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছিল। মেয়েদের চোখ ফেটে বেরিয়ে আসছিল অশ্রু। প্রতিটি যাত্রী মোহাবিষ্টের মত শুনছিল তার বেদনার্ত করুণ বর্ণনা।
ও বলছিল, ‘আমি পাদ্রীকে অবিশ্বাস করলাম। সন্দেহ জাগল যীশু, মরিয়ম এবং অদৃশ্য ঈশ্বরের প্রতি। বাড়ী ফিরে এলাম। আমার অন্ধ মায়ের প্রশ্ন, ‘আমার মেয়ে আসে নি বাবা?’
স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় আমার বোন?’
যীশু মেরীর নির্বাক ছবির মত দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। কিন্তু আমার ভেতর তৈরী হচ্ছিল এক ঝড়। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। সারাদিন ঘুরলাম উদ্দেশ্যহীন ভাবে। সন্ধ্যায় একটা খঞ্জর নিয়ে সাগর পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম। রাতের আঁধারে ছেয়ে গেল প্রকৃতি। অপেক্ষা করলাম। আরো গভীর হল রাত। যে বাড়িতে আমার বোন, সেদিকে চললাম। চলে এলাম মহলের পেছনে। সাধাসিধে মানুষ হলেও একটা বুদ্ধি এল। পেছনের দরজা দিয়ে ভতরে ঢুকে পড়লাম। একটা কক্ষে হৈ-হুল্লোড় চলছিল। সম্ভবত সুরার আসর। আমি অন্য একটি কক্ষে ঢুকলাম। একটা চাকর আমাকে বাঁধা দিল। খঞ্জর তার বুকে ঠেকিয়ে বোনের নাম বলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সে কোথায়?’
সে আমাকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিয়ে গেল। একটা কক্ষ দেখিয়ে বলল, ‘এখানে।’
আমি দ্রুত রুমে প্রবেশ করলাম। শিকল টানার শব্দে চকিতে পিছনে ফিরে দেখলাম দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কক্ষ শূণ্য। কেউ নেই।
খানিক পর দরজা খুলল। এক সংগে অনেকে ভেতরে ঢুকল। ওদের কাছে তরবারী এবং লাঠি। আমি কক্ষের জিনিসপত্র তছনছ করতে লাগলাম, অনেক ভাঙলাম।
ওরা আমাকে ধরে পিটাতে লাগল। এক সময় আমি অজ্ঞান হয়ে গোলাম। জ্ঞান ফিরতে দেখি আমার হাত পা শক্ত করে বাঁধা। আমার বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগ আনা হল। সাথে রাজার দরবারীর বাড়ীর আসবাবপত্র নষ্ট করা এবং হত্যার উদ্দেশ্যে তিনজকে আহত করা।
কেউ আমার কথা শুনল না। ত্রিশ বছরের শাস্তি দিয়ে কারাগারের জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হল। পাঁচ বছর শেষ হয়েছে। আমি এখন মানুষের মধ্যে নেই। তোমরা ‘কারা নির্যাতন’ দেখনি। দিনে জানোয়ারের মত খাটাতে হয়, রাতে কুকুরের মত গলায় শিকল পরিয়ে এক কক্ষে আটকে রাখা হয়। জানিনা আমার অন্ধ মা বেঁচে আছে কিনা। স্ত্রী সন্তান কোথায় তাও জানা নেই। আমি এক বিপজ্জনক ডাকাত। এ জন্য কাউকে আমার সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি।
সব সময় ভাবতাম ঈশ্বর সত্য না আমি সত্য। শুনেছি খোদা নিষ্পাপদের শাস্তি দেন না। তিনি আমায় কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন? কি অপরাধ করেছিল আমার অবোধ শিশুরা?
পাঁচ বছর মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগেছি। কিছুদিন পূর্বে কারাগারে এলেন দু’জন ফৌজি অফিসার। বিশেষ কাজের জন্য লোক খুঁজছেন। আমি রাজা বাদশার ব্যক্তিগত যুদ্ধে নিজকে জড়াতে চাইনি। রাজার প্রতি আমার আকর্ষণ নেই। কিন্তু যখন শুনলাম ক’জন মেয়েকে মুসলমানদের বন্দীখানা থেকে মুক্ত করতে হবে, বোনের কথা মনে পড়ল আমার।