বালিয়ানের হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে মুবি বলল, ‘শোন, ইসলাম কোন ধর্ম নয়, এজন্য তুমি দেশকে প্রাধান্য দিচ্ছ। আমার সাথে চল সাগরের ওপারে। দেখবে আমাদের মহান ধর্ম। তখন নিজের ধর্মকে ভুলে যাবে।
‘যে ধর্ম নিজের মেয়েদের অন্যের শয্যাসংগী হওয়াকে পূণ্যের কাজ মনে করে, সে ধর্মকে শত ধিক।’ আচম্বিত জেগে উঠল বালিয়ানের ঈমানী চেতনা। ‘তুমি নিজের সতীত্ব হারাওনি- আমার ইজ্জত লুণ্ঠন করেছ। আমি নই, তুমিই আমায় ভোগ করেছ।’
‘এক মুসলমানের ঈমান ক্রয় করার জন্য সতীত্ব এমন বড় কিছু নয়। আমি তোমার ইজ্জত লুণ্ঠন করিনি, তোমার ঈমান কিনে নিয়েছি। তোমাকে এ অবস্থায় পথে ছেড়ে যাব না। নিয়ে যাব ঝলমলে আলোর কাছে। তোমার ভবিষ্যত এবং পরকাল হিরার মত উজ্জল হয়ে উঠবে।’
‘আমি তোমার সে আলোর কাছে যাব না।’
‘দেখো বালিয়ান, পুরুষ যোদ্ধা। ওরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না। তুমি আমার পণ্য গ্রহণ করেছ। আমি তোমার ঈমান সুরার পাত্রে ডুবিয়ে দিয়েছি। তোমার ঈমান ক্রয়ের জন্য আমি দিয়েছি চড়া মুল্য। তোমার বাঁদী হয়ে, রক্ষিতা হয়ে থেকেছি আমি। হয় আমার সতীত্ব ফিরিয়ে দাও, নয় তোমার ঈমান দাও। তুমি এ ক্রয়-বিক্রয় থেকে মুখ ফেরাতে পার না। প্রতারণা করতে পার না এক দুর্বল মেয়ের সাথে।’
‘যে আলো সাগরে ওপারে দেখাতে চাইছ তা এখানেই দেখিয়েছ। আমি দেখতে পাচ্ছি হিরকের মত জ্বলজ্বল করছে আমার ভবিষ্যত।’
মুবি কিছু বলতে যাচ্ছিল, গর্জে উঠল বালিয়ান, ‘খামোশ বদমাশ মেয়ে! সালাহউদ্দীন আইয়ুবী আমার দুশমন হতে পারে কিন্তু আমি রাসূলের দুশমন নই। যে নবীর জন্য আমি সমগ্র মিসর এবং সুদান বিলিয়ে দিতে পারি সে পবিত্র নামের স্বার্থে আমি আইয়ুবীর কাছেও অস্ত্র সমর্পণ করতে প্রস্তুত।’
‘কতবার বলেছি, মদ কম খাও। অত্যাধিক মদপান, রাত জাগা এবং প্রতিদিন আমার সাথে এইসব করে তোমার মাথাটাই বিগড়ে গেছে। আমি যে তোমার স্ত্রী তাও ভুলে গেছো?’
‘আমি এক বেশ্যার স্বামী নই।’
মদের বোতল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল বালিয়ান। বন্ধুদের ডাকতেই ওরা ছুঁটে এল।
‘এ মেয়েরা এখন তোমাদের বন্দী। ওদের কায়রো ফিরিয়ে নিয়ে চল।’
‘কায়রো?’ একজনের হতচকিত প্রশ্ন, ‘আপনি কায়রো ফিরে যেতে চাইছেন?’
‘হ্যাঁ, কায়রো। হতবাক হচ্ছ কেন? এ মরুভূমিতে আর কতকাল ঘুরে মরব? যাও, জলদি ঘোড়া তৈরী কর, আর প্রতিটি ঘোড়ার পিঠে একটি করে মেয়ে বেঁধে দাও।’
বালিয়ানের তাঁবু থেকে আধমাইল দূরে থাকতেই থেমে গেল খৃষ্টান কমাণ্ডার। বিশ্রাম নেয়ার চমৎকার এলাকা। আশপাশে আরো কেউ তাঁবুঁ ফেলেছে কিনা খোঁজ নেয়ার জন্য রাতে তিনজন উষ্ট্রারোহীকে পাঠিয়ে দিল। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ হয়, উট চলে নিঃশব্দে। তিন আরোহী ছড়িয়ে গেল তিনদিকে।
বালিয়ান যখন মুবির সাথে কথা বলছিল, একটা উট এসে দাঁড়িয়েছিল পেছনে। বালিয়াড়ির আড়ালে। দূর থেকে মশালের আলো দেখে এগিয়ে এসেছিল আরোহী। উটের পিঠে বসে সে মেয়েদের দেখতে পাচ্ছিল। গল্প করছে বালিয়ানের সাথে। দূরে কটা ঘোড়া বাঁধা।
উষ্ট্রারোহী ফিরে এল সংগীদের কাছে। বলল, ‘শিকার তোমাদের পাশেই রয়েছে।’
সময় নষ্ট করল না কমাণ্ডার। হেঁটে রওনা হল। ওরা যখন পৌঁছল বালিয়ান তখন মেয়েদের বেঁধে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছে।
সংগীরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তার দিকে। নেতার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তর্ক জুড়ে দিল ওরা। সময় নষ্ট হতে লাগল। বালিয়ান অনেক কষ্টে বোঝাল যে, কায়রো গেলেই ওদের ভাল হবে।
বিস্ফারিত চোখে বালিয়ানে দিকে তাকাচ্ছিল মেয়েরা। ঘোড়ার পিঠে জিন চড়িয়ে ওরা মেয়েদের ধরে ফেলল।
আচমকা আক্রমণ হল। সুলতান আইয়ুবীর ফৌজ ভেবে বালিয়ান চিৎকার দিয়ে বলল, ‘আমরা অস্ত্র সমর্পণ করব। মেয়েদের কায়রো নিয়ে যাব।’
একটা খঞ্জর এসে বুকে বিঁধল তার। নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল বালিয়ান চিরদিনের জন্য। তার সংগীরা এত লোকের মোকাবেলা করতে পারল না। নিহত হল সবাই। মুক্ত হল মেয়েরা। কমাণ্ডারকে চিনতে পেরে খুশীতে উদ্বেলিত হয়ে উঠল মুবি। রাতে কাফেলার চারপাশে দাঁড় করানো হল সশস্ত্র সেন্ট্রি।
সুলতান আইয়ুবীর পাঠানো সওয়াররা এখান থেকে অনেক দূরে। রাতেও পথ চলছিল ওরা। সময় নষ্ট করতে চাইল না কেউ। সাথে পথ প্রদর্শক। পথ ভোলেনি সে।
কাফেলাকে সে আক্রমণের স্থানে নিয়ে গেল। মশাল জ্বেলে দেখাল শৃগাল শকুনের আধ খাওয়া রবিন এবং অন্যদের লাশ।
সওয়ারীদের দেখে শেয়াল পালিয়ে গেল। রক্ষীদের লাশ একত্রিত করে দ্রুত দাফন সারল কমাণ্ডার। এরপর ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে চলল। রাতে ট্র্যাক পেতে কষ্ট হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে ছাউনি ফেলা হল ওখানে।
খৃস্টানদের সবাই জেগে আছে। ওরা আনন্দিত। ভোরেই বেলাভূমির পথ ধরার সিদ্ধান্ত নিল খৃস্টান কমাণ্ডার। মেগনামা মারইউস বলল, ‘এখনো উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বেঁচে আছে সালাহউদ্দীন।’
কমাণ্ডার বলল, ‘মেয়েদের অনুসরণ করে কায়রো পৌঁছতে পারলে তা সম্ভব হত।’
‘কায়রো অনেক দূর। এজন্য এ পরিকল্পনা বাতিল।’
‘মৃত্যু ছাড়া এ পরিকল্পনা কেউ বাতিল করতে পারবে না।’ মেগনামার ঝাঝালো কণ্ঠ। ‘আমরা ক্রুশ ছুঁয়ে তাকে হত্যা করার জন্য শপথ করেছি। কেউ না গেলে আমি একা যাব। শুধু একটা মেয়ে এবং একজন সংগী প্রয়োজন।’