এখনো সূর্য ডুবেনি। অনেকদূর এগিয়ে এসেছে খৃস্টান কাফেলা। সামনে চড়াই। উপরে উঠল ওরা। দূরে প্রশস্ত মাঠ, মাঠ পেরিয়ে মরুদ্যান। খেজুর গাছ ছাড়াও বিভিন্ন বৃক্ষে ঘেরা। অনেকগুলো উট দেখা যাচ্ছে। ওদের পিঠ থেকে মাল নামানো হচ্ছে। ঘোড়া রয়েছে বার-চৌদ্দটি।
পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। এখন ওদের ঘোড়ার ভীষণ প্রয়োজন।
কমাণ্ডার কাফেলা থামাল। বলল, ‘আমরা ক্রুশে হাত রেখে সত্যিকার শপথ নিয়েছিলাম। দেখলে তো ক্রুশের মহিমা। ঈশ্বর আকাশ থেকে এ সওয়ার পাঠিয়েছেন। ঈশ্বরপুত্র তোমাদের সাহায্যের জন্য নেমে এসেছেন আকাশ থেকে।
ক্লান্তির চিহ্ন মুছে গেল ওদের চেহারা থেকে। এখনো চিন্তা করছে না এগুলো হাত করবে কিভাবে?
শ’খানেক উট সেনাবাহিনীর জন্য রেশন নিয়ে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে শত্রুর ভয় নেই, এজন্য পাহারা তেমন জোরালো নয়। দশজন ঘোড়সওয়ার পাঠানো হয়েছে। উট চালকরা নিরস্ত্র।
ডাকাতরা ছোটখাট কাফেলা লুট করলেও সামরিক কনভয় আক্রমণ করেনা কখনো। আগেও এভাবে সামরিক ঘাঁটির জন্য রসদ পাঠানো হয়েছে। নির্ভয়ে চলছে রসদবাহী কাফেলা। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে।
খৃস্টান কমাণ্ডার অভিযাত্রীদের নিয়ে গেল পাহাড়ের আড়ালে। বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত ওরা। আবেগ এবং সাহসেরও অভাব নেই। গভীর রাতে দু’জন গিয়ে দেখে এল। ঘুমিয়ে আছে রসদবাহী কাফেলা। সশস্ত্র মাত্র দশজন।
ভের হওয়ার সামান্য আগে রওনা দিল ওরা। সাবধানে এগিয়ে গেল। ঘুমন্ত দশজন প্রহরীকে হত্যা করল। কোচম্যানরা বুঝতেই পারলনা কি হচ্ছে। চিৎকার দিল কেউ, সে চিৎকার থেমে গেল তরবারীর আঘাতে।
ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য খৃস্টানরাও চিৎকার করতে লাগল। জেগে উঠল সব কোচওয়ান। শুরু হল হত্যাযজ্ঞ। কমাণ্ডার গলা চড়িয়ে বলল, ‘এগুলো মুসলিম বাহিনীর রেশন। নিশ্চিহ্ন করে দাও। মেরে ফেল উটগুলি। উটচালকদের হত্যা কর।’
খৃষ্টানরা নির্বিচারে তরবারী চালাতে লাগল। বারোটা ঘোড়া দখল করল কমাণ্ডার। ভোরের আলো ফুটল। উট এবং মানুষের লাশে ভরে গেছে মাঠ। কেউ কেউ তড়পাচ্ছে এখনো। পালিয়ে গেছে কেউ। প্রতিরোধ করার মত কেউ নেই।
ঘোড়া নিয়ে সরে পড়ল খৃস্টান অভিযাত্রীরা। ওদের বাহনের প্রয়োজন মিটেছে। এখন ওরা ছুটে চলছে পরবর্তী শিকারের উদ্দেশ্যে।
বালিয়ানের সমগ্র সত্ত্বায় জড়িয়ে আছে মুবি। মদ বিকল করে রেখেছে স্নায়ুগুলো। এখন তার কাছে সাত সাতটা রূপসী যুবতী। ভুলে গেছে বিপদের কথা।
মুবি বার বার বলছে, ‘কোথাও বিশ্রাম নেয়া ঠিক নয়। তাড়াতাড়ি সাগর তীরে পৌঁছার চেষ্টা কর। আমাদের পেছনে শত্রু ধেয়ে আসছে।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা। নিঃশঙ্কুচিত্ত মহারাজা সে। হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে মুবির কথা।
মেয়েদের মুক্ত করার পরের রাতে এক জায়গায় বিশ্রাম করছিল ওরা। বালিয়ান মুবিকে বলল, ‘তোমরা সাত যুবতী। আমরা সাতজন পুরুষ। দেখেছো আমার বন্ধুরা কত বিশ্বাসী। আজ ওদের পুরষ্কার দিব। আজ আমার ছয় বন্ধুর সাথে থাকবে তোমার ছয় বান্ধবী। তুমি থাকবে আমার সাথে। আজ আমরা আনন্দ করব।’
‘অসম্ভব!’ ক্রোধকম্পিত কণ্ঠে বলল মুবি, ‘আমরা বাজারের মেয়ে নই। ওরা তোমার কোনা বাদী নয় যে, যা ইচ্ছে তা করবে। বাধ্য হয়ে আমি তোমাকে দেহ দিয়েছি। এরা কারো ভোগর সামগ্রী হবে না।’
‘আনন্দ তুমি একাই লুটবে তা তো হয়না সুন্দরী। তোমার বান্ধবীদেরও কিছু ভাগ দাও।’ বালিয়ানের কণ্ঠে তরল রসিকতা।
‘বালিয়ান, তুমি ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ।’ রাগে ফেটে পড়ছে মুবি।
‘তোমরা কতটুকু ভদ্র তা জানা আছে আমার। আমাদের জন্য তো মরা দেহের উপঢৌকন নিয়ে এসেছ। এরা কতজনের শয্যা-সংগী হয়েছে তার হিসেব দিতে পারো? তোমরা কেউ মেরী নও, এ কথা কে না জানে।’
‘কর্তব্য পালন করতে গিয়ে আমরা দেহের উপঢৌকন পেশ করেছি, ভোগের সামগ্রী হওয়ার জন্য পুরুষদের সংগ দেইনি। আমাদের জাতি, ধর্ম আমাদের ওপর এক গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছে। সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা দেহ, যৌবন, রূপলাবণ্য এবং সতীত্বকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি। আমরা দেহ দিয়েছি আমাদের ওপর অর্পিত কর্তব্য ও দায়িত্বের অংশ হিসেবে, ভোগের জন্য নয়। এখন তুমি যা বলছ তা ভোগ বিলাস ছাড়া কিছুই নয়। যেদিন আমরা ভোগ বিলাসে জড়িয়ে পড়ব সেদিন থেকে শুরু হবে খৃস্টানদের পতন। ক্রুশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
‘মুবি, আমার বন্ধুরা জীবন পণ করে ক্রুশের জন্য লড়ছে। ওদের উজ্জীবিত করা তোমাদের দায়িত্ব।’
‘ট্রেনিং দেয়ার সময় আমাদের বলা হয়েছে, এক মুসলিম নেতাকে করায়ত্ত করার জন্য দশ জনের শয্যাসংগী হওয়া শুধু বৈধ নয় বরং পুণ্যের কাজ। মুসলমান ধর্মীয় গুরুকে দেহ দান করাকে আমরা সেরা পূণ্য মনে করি।’
‘তাহলে তুমি খৃস্টানদের স্বার্থে আমাকে ব্যবহার করছ?’
‘কেন, এখনো সন্দেহ আছে?’
‘কিন্তু আমি তো খৃস্টান নই।’
‘তা নও। কিন্তু খৃস্টানদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্বকে কি অস্বীকার করবে? বলতো খৃস্টানদের সাথে তোমাদের এ বন্ধুত্ব কেন?’
‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য, খৃস্টানদের রক্ষার জন্য নয়। আমি মুসলমান কিন্তু প্রথমে একজন সুদানী।’
‘আর আমি সর্বপ্রথম একজন খৃস্টান। এর পর যে দেশের জন্ম নিয়েছি সে দেশের সন্তান।’