ওরা কায়রো যাবে, কিন্তু কোন বাহন নেই। ক্যাম্পের ঘোড়া চুরি করাও সহজ নয়। সুর্য ওঠার এখনও অনেক দেরী, ওরা হাঁটা ধরল। পথে কোন সওয়ারী পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে। বন্দীদের পথেই ধরতে হবে, তা না হলে কায়রো গিয়ে ওদের মুক্ত করা কঠিন হবে।
মৃত্যু হাতে নিয়েই ওরা অভিযানে এসেছে। সফল হলে পুরস্কার পাবে। তা দিয়ে জীবন ভর বসে বসে খেতে পারবে। তিরিশ বছর মেয়াদের জেল খাটছিল মেগনামা মারইউস। ডাকাতির আসামী। আরো একটা কেস ছিল খুনের। ওটার রায় বেরোলে তার ফাঁসি হয়ে যেতো।
তার সাথের দু’জনের শাস্তি ছিল চব্বিশ বছরে। কারাগারের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওরা মৃত্যু কামনা করত। এদের শাস্তি মওকুফ করে এ অভিযানে পাঠানো হয়েছে।
এক পাদ্রীর হাতে শপথ করেছে ওরা। পাদ্রী বলেছেন, যত মুসলমান হত্যা করবে, ঈশ্বর তার দশগুণ পাপ মোচন করবেন। সালাহউদ্দীনকে হত্যা করলে ক্ষমা করা হবে সারা জীবনের পাপ। পরকালে পবিত্র যীশুর সাথে একসঙ্গে স্বর্গে থাকবে।
জেল থেকে মুক্তি আর স্বর্গপ্রাপ্তি ও পুরস্কারের লোভে ওরা এসেছে এ দলে। ওদের ভেতর ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা।
জীবন বাজি রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা। হয়ত আইয়ুবীকে হত্যা করবে, নয়তো জীবন বিলিয়ে দেবে। বাকী আঠারজন পরাজিত বাহিনীর সেনা সদস্য। ওদের হৃদয়ে জ্বলছিল প্রতিশোধের আগুন। প্রজ্বলিত আবেগ নিয়ে ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল কায়রোর দিকে।
দ্বিপ্রহর। সুলতান আইয়ুবীর হেডকোয়ার্টারের সামনে এসে থামল এক ঘোড়সওয়ার। ঘোড়ার গা ঘামে জবজবে। ক্লান্তিতে আরোহীর মুখে কথা সরছেনা। নেমে পড়ল আরোহী। কেঁপে উঠল ঘোড়ার শরীর। মাটিতে পড়ে মরে গেল ঘোড়াটা, টানা দেড় দিন একনাগাড়ে দৌড়িয়েছে। এর মধ্যে পেটে দানাপানি পড়েনি, বিশ্রামও জুটেনি কপালে।
সুলতান আইয়ুবীর রক্ষীরা সওয়ারকে ঘিরে ধরল। পানি পান করাল। কথা বলার উপযুক্ত হতেই বলল, ‘কোন সালার অথবা কমাণ্ডারের সাথে দেখা করব।’
সালাহউদ্দীন আইয়ুবী নিজে বেরিয়ে এলেন। আগন্তুক দাঁড়িয়ে সালাম করে বলর, ‘আমি একটা দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি।’
সুলতান তাকে ভেতরে নিয়ে বললেন, ‘এবার বল।’
‘বন্দী মেয়েরা পালিয়ে গেছে। আমােদরও সবাই নিহত। আমি আহত, তবে কোনরকমে আমি বেঁচে গেছি। ওদের পুরুষ বন্দীদের আমরা হত্যা করেছি। আক্রমণকারী কে জানিনা। আমরা ছিলাম মশালের আলোয়। আক্রমণকারী অন্ধকার থেকে তীর ছুড়েছে।’
সুলতান একজন কমাণ্ডার এবং গোয়েন্দা অফিসারকে ডেকে আনালেন। বললেন, ‘ও কি বলছে শোন।’
সিপাইটি ঘটনা শোনাল। বলল, ‘বন্দী মেয়ের সাথে কমাণ্ডারের সম্পর্কের কথা।’
আইয়ুবী বললেন, ‘তার মানে মিসরেও তাদের কমাণ্ডো বাহিনী রয়েছে।’
‘হতে পারে।’ আলী বললেন, ‘আবার মরু ডাকাত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এমন সুন্দরী যুবতীতো ওদের জন্য মহা মূল্যবান।’
‘ওর কথা মন দিয়ে শোননি তুমি। বন্দীরা লাশের অস্ত্র তুলে এনে আক্রমণ করেছিল ঘুমন্ত প্রহরীদের। আমাদের যে দু’জন প্রহরী এটা দেখেছেন তারা তীর মেরে ওদের হত্যা করার পরপরই আক্রান্ত হয়েছে আমাদের প্রহরীরা। এতে মনে হয় কমাণ্ডো বাহিনী ওদের অনুসরণ করছিল।’
মহামান্য সুলতান, এ মুহূর্তে ওদের ধাওয়া করার জন্য বিশটি ঘোড়া এবং এই সৈনিককে প্রয়োজন। আক্রমণ কে করেছে পরে দেখা যাবে।’ বলল এক কমাণ্ডার।
‘আমার একজন সহকারীকে সাথে পাঠাব।’ আলী বললেন, ‘একে খাবার দাও। খাওয়ার পর ও বিশ্রাম করবে। প্রয়োজনে বিশের অধিক ঘোড়া নিতে পার।’
আগন্তুক বলল, ‘আমি যেখান থেকে ঘোড়া নিয়েছি ওখানে ঘোড়াটা বাঁধা ছিল, কিন্তু কোন লোক ছিল না। সম্ভবতঃ ওরাই আক্রমণকারী। ওখানে আমি আটটি ঘোড়া দেখেছি। নিশ্চয়ই ওরা আটজন ছিল।’
‘কমাণ্ডো বাহিনীতে বেশী লোক থাকেনা। ইনশাআল্লা আমরা ওদের গ্রেফতার করতে পারব।’ কমাণ্ডার বলল।
‘মনে রেখো ওরা কমাণ্ডো বাহিনী।’ সুলতান বললেন, ‘মেয়েগুলো গোয়েন্দা। ওদের একজন সৈন্য অথবা একটা মেয়েকে ধরতে পারলে মনে করবে দু’শ শত্রু সৈন্য পাকড়াও করেছ। এক নারী কারো তেমন ক্ষতি করতে পারেনা। কিন্তু এক গুপ্তচর মেয়ে একটা দেশ এবং জাতি ধ্বংস করে দিতে পারে। ওরা অত্যন্ত বিপজ্জনক। একবার মিসরে ঢুকে গেলে গোটা সেনাবাহিনী অকর্মণ্য হয়ে পড়বে।
সুলতান আরো বললেন, ‘একজন পুরুষ বা মেয়ে গোয়েন্দাকে ধরার জন্য আমি একশত সিপাই কোরবানী দিতে প্রস্তুত। কমাণ্ডোরা ধরা না পড়লে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যে কোন মূল্যেই হোক মেয়েগুলোকে গ্রেপ্তার করতে হবে। জীবিত ধরতে না পারলে তীর মেরে শেষ কর দিও।’
এক ঘন্টা পর বিশজন দুঃসাহসী সৈনিক রওয়ানা হল। পথ দেখাচ্ছিল পালিয়ে আসা প্রহরী। কমাণ্ডার আলী বিন সুফিয়ানের সহকারী জাহেদীন। বিশজনের একজন ছিল ফখরুল মিসরী। আলী জানতো না ওরা মুবি এবং বালিয়ানকেই ধাওয়া করতে যাচ্ছে।
কাফেলার একুশতম ব্যক্তি কমাণ্ডার যাচ্ছেন মেয়েদের পাকড়াও করতে। ওদিকে খৃস্টান কাফেলার একুশতম ব্যক্তিও কমাণ্ডার। তার উদ্দেশ্য মেয়েদেরকে মুক্ত করা। এরা যাচ্ছিল পায়ে হেঁটে। যাদের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে তারা, তাদের কারো জানা ছিল না, দু’দলের কে কোথায় আছে।