রাতের নীরবতা ভেঙে ভেসে এল অস্ফুট শব্দ। চমকে উঠল ওরা। উৎকর্ণ হয়ে রইল। সতর্ক পা ফেলে দু’জনে এগিয়ে গেল শব্দ লক্ষ্য করে। দেখল, গাছের নীচে দু’টো ছায়ার অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যাচ্ছে।
মুবি আরও এগিয়ে গিয়ে ওদের কথা শুনতে লাগল। মেয়েটার কথা শুনে সে স্পষ্ট বুঝতে পারল যে, এ তার সঙ্গিনীদের একজন।
কমাণ্ডারের তৎপরতা স্পষ্ট। বদামায়েশী করার জন্য অসহায় মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে।
পিছিয়ে এল সে। বালিয়ানকে বলল, ‘লোকটা মিসরী। আমার সঙ্গীনী একটা মেয়েকে ভোগ করার জন্য নিয়ে এসেছে। একে রক্ষা কর। মিসরী তোমায় শত্রু, মেয়েটা বন্ধু। ও আমারয়ে চেয়ে বেশী সুন্দরী। ওকে এনে তোমার হারেমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি কর।’
বালিয়ান মদ পান করছিল, মুবির কথায় উঠে দাঁড়াল। খাপ থেকে খঞ্জর বের করে শিকারী বেড়ালের মত পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল। কমাণ্ডার কিছু বুঝে উঠার আগেই তার পিঠে আমূল বসিয়ে দিল খঞ্জর। টেনে নিয়ে আবার আঘাত করল।
আকস্মিক এ আক্রমণে ভয় পেয়ে মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। ওকে দূর থেকে ডাকল মুবি। ও ছুটে গিয়ে মুবিকে জড়িয়ে ধরল।
‘অন্যরা কোথায়?’ মুবির প্রশ্ন।
সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে বলল মেয়েটা। বলল, ‘ওরা এখন পনেরজন সৈনিকের পাহারায় রয়েছে।’
বালিয়ান দৌড়ে গিয়ে সংগীদের ডেকে নিয়ে এল। সাথে অস্ত্র। কমাণ্ডারকে ডাকতে ডাকতে এদিকে এগুচ্ছিল এক প্রহরী। বালিয়ানের এক সংগী তীর মেরে তাকে হত্যা করল। মেয়েটা ওদের নিয়ে এগিয়ে চলল ক্যাম্পাসের দিকে।
টিলার নীচে আলো জ্বলছে। বালিয়ান টিলার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখল মাটিতে গাঁথা লাঠির মাথায় দুটো মশাল। প্রহরীরা লাশগুলো ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েগুলো জড়ো হয়ে আছে পাশে। তা দেখে মুবি এবং মেয়েটা কাঁদকে লাগল।
বালিয়ান সঙ্গীদের বলল, ‘তীর ছোঁড়।’
একসঙ্গে দু’টো তীর নিক্ষিপ্ত হল। লুটিয়ে পড়ল দু’জন প্রহরী। ওরা তখনও বুঝে উঠতে পারছে না কি ঘটছে, আরো দু’টা তীরে পড়ে গেল আরো দু’জন সৈনিক। একজনের দেহে বিঁধল তিনটে তীর।
উট চালকরা অন্ধাকারে লুকিয়ে পড়ল। মুবি মেয়েদের কাছে ছুটে এল। হঠাৎ ওদের কানে ভেসে এল অশ্বক্ষুরের শব্দ।
‘এখানে আর দেরী করা যাবে না।’ বালিয়ান বলল, ‘ওদের একজন পালিয়ে যাচ্ছে কায়রোর দিকে। এখুনি আমাদের পালানো উচিত।’
প্রহরীদের ঘোড়াগুলো নিয়ে নিজের ক্যাম্পের দিকে চলল বালিয়ান। তার একটা ঘোড়া নেই। আহত মিসরী সিপাইটি এদের ঘোড়া নিয়েই পালিয়েছে। নিজের ঘোড়া পর্যন্ত যেতে পারেনি সে।
চৌদ্দটি ঘোড়ার পিঠে জিন চাপানো হল। মালামাল চাপাল দুটার পিঠে। রওনা হল কাফেলা।
মেয়েরা মুবিকে সব ঘটনা খুলে বলল। কিন্তু রবিনদের মৃত্যুর রহস্য বলতে পারল না। মুবি বলল, ‘আইয়ুবীর ক্যাম্পে রবিনের সাক্ষাৎ যেমন অযাচিত ভাবে পেয়েছিলাম, তোমাদেরও পেলাম তেমনি আকস্মিকভাবে। এতে বলব না, পবিত্র যীশু আমাদের সফল করবেন। যে কাজেই আমরা হাত দিয়েছি, ব্যর্থ হয়েছি। রোম উপসাগরের পাড়ে আমাদের সৈন্যরা পরাজিত হয়েছে। মিসরে পরাজিত হয়েছে আমাদের বন্ধু সুদানী ফৌজ। রবিনের মত লোক নিহত হল। জানিনা কি হবে আমাদের পরিণতি। মনে হয় যীশু আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট।’
‘আমি বেঁচে থাকতে তোমাদের গায়ে কেউ হাত তুলতে পারবে না।’ বালিয়ান বলল, ‘আমার সিংহদের কাজ কি দেখনি?’
রোম উপসাগরের তীরে এসে লাগল একটি নৌকা। নেমে এল তিনজন লোক, পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল মুসলিম সেনা ক্যাম্পের দিকে। কথা বলছে ইটালীর ভাষায়।
ক্যাম্পে পৌঁছল ওরা। ওদের কথা শুনে ইটালীর খৃস্টান বন্দীদের ডেকে আনা হল। ওরা বলল, ‘এরা ইটালী থেকে এসেছে হারিয়ে যাওয়া বোনের খোঁজে। সেনাপতির সাথে দেখা করতে চাইছে।’
ক্যাম্পের অধিনায়ক বাহাউদ্দিন শাদ্দাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হল ওদের।
তিনজনের একজন আধ বয়েসী, দু’জন যুবক। দোভাষী বলল, ‘ওদের যুবতী বোনকে খৃস্টান সৈন্যরা তুলে নিয়ে এসেছে। এরা শুনেছে ওদের বোনেরা এখন আইয়ুবীর ক্যাম্পে আছে। বোনদের খোঁজে সাগর পাড়ি দিয়ে এদ্দুর এসেছে এরা।’
তাদের বলা হল মেয়েরা এসেছে তিনজন নয় সাতজন। সাবাই গুপ্তচর। তিনজনই বলল, ‘আমরা গরীব। গুপ্তচরীর সাথে আমাদের বোনদের কোন সম্পর্ক নেই। সাতজনকে আমরা জানিনা। আমাদের বোনদের খোঁজে আমরা এসেছি।
শাদ্দাদ বললেন, ‘যে সাতজন আমাদের কাছে এসেছে, তার মধ্য থেকে পালিয়ে গেছে একজন। বাকী ছ’জনকে আজই কায়রো পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমরা বরং ওখানে যাও। আমাদের সুলতান ভাল মানুষ।’
‘বিশ্বাস করুন, আমাদের বোনেরা গোয়েন্দা নয়। আপনারা যাদের পেয়েছেন তারা গোয়েন্দা হলে ওরা আমাদের বোন নয়। আমাদের হতভাগী বোনেরা তাহলে হয়ত সাগরে ডুবে মরেছে। না হয় খৃস্টানদের কাছেই আছে।’ শাদ্দাদের মনটা ছিল নরম। তিনজন গ্রাম্য লোকের দুঃখে তিনিও ব্যথিত হলেন। খাতির যত্ন করে বিদায় করলেন ওদের। চলে গেল ওরা। কোথায় গেল কেউ জানল না।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা নিরাপদ এলাকায় পৌঁছল। এক পাহাড়ের কোলে আঠারজন কমাণ্ডো ওদর জন্য অপেক্ষা করছিল।
তিনজনের মধ্যে বয়সী লোকটি সেগনামা মারইউস। সে এসেছে মেয়েদের মুক্ত করতে এবং সুলতান আইয়ুবীকে হত্যা করতে। সাগর থেকে পাহাড়ের ভেতর দিকে চলে গেছে এক সংকীর্ণ চ্যানেল। পাড়ে নেমে ওখানে নৌকা লুকিয়ে রেখেছিল ওরা।