ভোরে কাফেলা রওনা হল। পথ পরিবর্তন করল কমাণ্ডার। বলল, ‘এদিকে যাত্রা বিরতির জন্য সুন্দর জায়গা পাওয়া যাবে। খাওয়ার জন্য পাশের গ্রাম থেকে ডিম এবং মুরগীও আনতে পারবো।
কমাণ্ডার তাদের বিনোদনের সুযোগ দিচ্ছে ভেবে প্রহরীরা ভীষণ খুশী। কিন্তু দু’জন প্রহরী কমাণ্ডারের এসব কাজে খুশী হতে পারেনি। ওরা তাকে বলল, ‘আমরা বিপজ্জনক বন্দীদের নিয়ে যাচ্ছি। ওদের সবাই গুপ্তচর। যতশীঘ্র সম্ভব ওদেরকে সংস্থার হাতে পৌঁছে দেয়া উচিৎ। অকারণে সফর দীর্ঘ করা ঠিক হবে না।’
‘তাড়াতাড়ি পৌঁছব কি দেরীতে পৌঁছব সে দায়িত্ব আমার। এ ব্যাপারে তোমাদের না ভাবলেও চলবে। জবাবদিহী করতে হলে আমি করব।’
ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল প্রহরী দু’জন। তারপরও দু’জন আড়ালে আবডালে শলাপরামর্শ করতে লাগল।
দুপুর। দূর আকাশে একঝাঁক শুকুন উড়ছে। হয়ত লাশ আছে আশপাশে। এলাকাটা বালিয়াড়ি হলেও ছোট ছোট টিলায় মরুবৃক্ষ আছে।
কাফেলা একটা টিলায় পৌঁছল। চড়াই পেরিয়ে বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠে শুকুনের ভিড়। ওরা তাকিয়ে দেখল প্রান্তর জুড়ে অসংখ্য লাশ। সুলতান আইয়ুবীর কমাণ্ডো বাহিনীর আক্রমণে নিহত সুদানী ফৌজ। সুদানীরা লাশ তুলে নিতে পারেনি, পালিয়ে গেছে জীবন নিয়ে। লাশের পাশে পড়ে আছে অস্ত্র। ঢাল, তলোয়ার, নেযা, বল্লম।
ময়দানের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে চলল ওরা। পড়ে থাকা অস্ত্রের দিকে জুলজুল চোখে তাকাল রবিন। কথা বলল সংগীদের সাথে।
ডান দিকে সবুজের সমারোহ। সুপেয় ঝরণা। চোখের ইশারায় কমাণ্ডারকে ডাকল মেয়েটা। এগিয়ে এল মিসরী। মেয়েটা বলল, ‘চমৎকার জায়গা, চলোনা বিশ্রাম করি।’
কাফেলাকে থামতে হুকুম দিল কমাণ্ডার। ঝরণার পাশে থামল ওরা। আরোহীরা নেমে পড়ল উট এবং ঘোড়া থেকে। পশুগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে। রাতে থাকার জন্য তাঁবু খাটানো হল দুই টিলার ফাঁকে সবুজ ঘাসে ভরা প্রশস্ত মাঠে।
মরুভূমিতে নেমে এসেছে অন্ধকার রাত। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু কমাণ্ডারের চোখে ঘুম নেই। কখন মেয়েটার কাছে পৌঁছবে এ ভাবনায় অস্থির সে।
জেগে আছে মেয়েটাও। ‘আজ কমাণ্ডারকে মাতাল করতে হবে’ মনে মনে বলল ও।
নীরব রাতে প্রহরীদের নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। মিসরী উঠল। পা টিপে টিপে পৌঁছল মেয়েটার কাছে। টিলা ওপাশে চলে গেল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল অন্য টিলায়। গাছের ছায়ায় গাঢ় অন্ধকার। ওরা একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসল।
ছাউনিতে কমাণ্ডার নেই। প্রহরীরা সবাই ঘুমিয়ে আছে। কোন সেন্ট্রি নেই। এ অপূর্ব সুযোগকে কাজে লাগালো রবিন। নিঃশব্দে সংগীদের জাগাল। হামাগুড়ি দিয়ে দূরে সরে গেল একে একে সবাই।
টিলার আড়াল হয়ে দৌড়াতে লাগল ওরা। পৌঁছল লাশের কাছে। তীর ধনুক এবং বর্শা নিয়ে ফিরে এল। ঘুমন্ত প্রহরীদের পাশে এসে দাঁড়াল রবিন। বর্শা তুলল মারার জন্য, অন্য চারজনও তৈরী। ঘুমের মধ্যে একসঙ্গে পাঁচজনকে শেষ করতে পারছে এ আনন্দে উদ্ভাসিত ওদের চেহারা।
নিহতদের চিৎকার সঙ্গীদের কানে পৌঁছার আগেই বাকীদেরও নিরস্ত্র অবস্থায়ই হত্যা করতে হবে। রবিন পেছনের দিকে তাকাল একবার। দেখল একটু দূরে ঘুমিয়ে আছে উট চালক তিনজন। কমাণ্ডারকে নিয়ে মেয়েটা সরে গেছে দূরে।
রবিন একজন সৈনিকের বুক লক্ষ্য করে বর্শা নামিয়ে আনতে শুরু করেছে, হঠাৎ একটা তীর এসে তার বুকে বিঁধে গেল। অন্য একটা তীর লাগল তার সংগীর গায়ে। ওরা কিছু বুঝে উঠার আগেই আরও দুটো তীর ওদের দুই সঙ্গীর বুকে এসে বিঁধল।
এগিয়ে এল তীর নিক্ষেপকারী সৈনিক দু’জন। কমাণ্ডারের সাথে এদেরই কথা কাটাকাটি হয়েছিল দিনের বেলা।
শুয়েছিল ওরাও। বন্দীরা ওদের পাশ দিয়ে যাবার সময় চোখ খুলে গেল একজনের। তাকিয়ে দেখল বন্দীরা পালিয়ে যাচ্ছে। ওরা একটু দূরে যেতেই পাশের জনকে জাগাল সে। ফিসফিস করে বলল, ‘ওরা পালাচ্ছে।’
‘কারা?’
‘বন্দীরা।’
‘কই? কোন দিকে গেছে?’ দ্রুত উঠে বসল সে। প্রথম সৈনিকটি হাত ইশারায় বন্দীদের গমনপথের দিকটা দেখাল ওকে। প্রথম সৈনিকটি উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চল, ওদের পিছু নিতে হবে।’
সাবধানে বন্দীদের অনুসরণ করে এগিয়ে চলল দু’জন। দেখল বন্দীরা অস্ত্র কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসছে।
টিলার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল দু’জন। বন্দীরা ঘুমন্ত প্রহরীদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হতেই এরা তীর ছুঁড়ল। ওরা পড়ে যেতেই কমাণ্ডারকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসল সৈনিক দু’জন।
তাদের ডাক চিৎকারে জেগে উঠল মেয়েগুলো। সাথে সাথে প্রহরীরাও। মেয়েগুলো লাশের দিকে তাকাল ভয়-বিস্ফোরিত নয়নে। প্রত্যেকর বুকে একটা করে তীর বিঁধে আছে।
এদের পরিকল্পনা মেয়েরা জানত। হতাশা ফুটে উঠল ওদের চেহারায়। এদিক ওদিক তাকাল ওরা। দেখল মিসরী কমাণ্ডার ও একটা মেয়ে সেখানে নেই।
যখন বন্দীদের বুকে তীর বিঁধেছে ঠিক সে মুহূর্তে পাশের টিলায় একটা খঞ্জর কমাণ্ডারের পিঠে আমূল প্রবেশ করল। টিলার উপর পড়ে রইল তার লাশ।
মেয়েটাকে নিয়ে টিলার ওপর বসেছিল কমাণ্ডার। ওরা জানতোনা তার খানিক দূরে বালিয়ানের তাঁবু। ঘোড়াগুলো একটু দূরে। মুবিকে নিয়ে এদিকে এসেছিল বালিয়ান, রক্ষীদের চোখের আড়ালে। হাতে মদের বোতল, চাদর বিছিয়ে বসল মুবিকে নিয়ে।