অনিচ্ছাসত্বেও তাকে বালিয়ানের ভোগের সামগ্রী হতে হচ্ছে। ও কয়েকবারই বলেছে, ‘বিশ্রাম কম করে তাড়াতাড়ি এগিয়ে চল।’ কিন্তু বালিয়ান একটু ভাল জায়গা পেলেই থেমে যেত।
একরাতে বালিয়ানকে মদ ঢেলে দিচ্ছে মুবি। ইচ্ছে করেই বেশী খাওয়ালো। নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল বালিয়ান। প্রহরীরাও শুয়ে আছে।
ধীরপায়ে এক প্রহরীর কাছে গেল ও। যুবক বয়স। সাহসী। বালিয়ানের বিশ্বস্ত। আলতো স্পর্শে তাকে জাগাল মুবি। নিয়ে গেল খানিক দূরে। বলল, ‘তুমিতো জান আমি কে? কেন এসেছি।’
যুবক কোন কথা না বলে মাথা নাড়ল।
‘তোমাদের জন্য সাহায্যের আশ্বাস নিয়ে এসেছিলাম। চেয়েছিলাম সালাহউদ্দীনকে সরিয়ে তোমাদেরকে ক্ষমতায় বসাব। কিন্তু তোমাদের এ কমাণ্ডার অপদার্থ। বিদ্রোহের পরিকল্পনা করবে তা নয়, প্রতিরাতে মাতাল হয়ে আামাকে ভোগ করা শুরু করল। আমি হলাম তার হারেমের বন্দিনী।’
সামান্য বিরতি নিয়ে মুবি আবার বলতে শুরু করল, ‘কোন চিন্তা ভাবনা না করেই ফৌজকে দু’ভাগে ভাগ করল ও। আক্রমণ করল বুদ্ধিহীনের মত। যার ফলে তোমাদের এক বিশাল বাহিনী শেষ হয়ে গেল। তোমাদের পরাজয়ের জন্য এ লোকটা সম্পূর্ণরূপে দায়ী। এখনও সে আমাকে ভোগ করে চলছে। আমাকে বলছে দেশে নিয়ে আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু ওকে আমি ঘৃণা করি।
বিয়ে করতে হলে কাকে করব সে সিদ্ধান্ত আমার। তোমাকে আমি ভালবাসি। তুমি যুবক, সাহসী এবং বুদ্ধিমান। প্রথম দেখার দিন থেকেই তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। এ বুড়ো হাবড়াটার হাত থেকে আমাকে উদ্ধার কর। তোমাকে আমি সাগরের ওপারে নিয়ে যাব। সেনাবাহিনীর বড় পদ এবং ধন সম্পদ থাকবে তোমার পদতলে। কিন্তু একে শেষ না করলে তা সম্ভব নয়। ও ঘুমিয়ে আছে। ওকে হত্যা করে চল আমরা দু’জনে পালিয়ে যাই।’
সৈনিকটার গলা জড়িয়ে ধরল মুবি। মুবির মাতাল করা রূপ তাকে পাগল করে তুলল। কিছুক্ষণ জড়িয়ে রেখে তাকে ছেড়ে সরে বসল ও। যুবক এগোল তার দিকে। আচমকা একটা বশা এসে বিঁধল যুবকের পিঠে। ‘আঃ!’ শব্দ করে লুটিয়ে পড়ল সে। বর্শা টেনে তুলল একজন। বলল, ‘নেমকহারামের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’
আতংকিত চিৎকার বেরিয়ে এল মুবির কণ্ঠ থেকে। দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমরা লোকটাকে মেরে ফেললে!’
পেছন থেকে কেউ তার বাহু খামছে ধরল। ঝাঁকুনি দিয়ে টেনে নিয়ে চলল বালিয়ানের কাছে।
‘আমরা এ ব্যক্তির পালিত বন্ধু। তার সাথেই আমাদের জীবন মরণ। আমাদের কাউকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপাতে পারবে না। নিমকহারাম তার শাস্তি পেয়েছে।’
‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ ভেবেছ একবারও?’
‘সাগরে ডুবতে যাচ্ছি। তোমার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। বালিয়ান যেখানে যাবে, আমরাও সেখানে যাব।’
বালিয়ান তখনো মাতাল হয়ে পড়ে আছে। ওরা দু’জন শুয়ে পড়ল আবার। পরদিন বালিয়ানকে সব ঘটনা খুলে বলা হল। মুবি বলল, ‘লোকটা আমাকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।’
রক্ষীদের ধন্যবাদ জানাল বালিয়ান। আবার পথ চলতে শুরু করল ওরা। মুবি আবারও দ্রুত চলার জন্য তাগাদা দিতে লাগল। বলল, ‘যতশ্রীঘ্র সম্ভব এগিয়ে যাওয়া উচিৎ।’
বালিয়ান চলল তার নিজস্ব গতিতে। মুবির রূপ যৌবন তাকে বিবেকশূন্য করে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু পরিস্থিতি সম্পর্কেও সে ছিল সজাগ। চারদিক দেখেশুনে সাবধানে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তার। মুবি বুঝেছে, বালিয়ানের হাত থেকে মুক্ত হওয়া এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। প্রয়োজনে এরা বন্ধুকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয় না।
বিদ্রোহ পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সুলতান আইয়ুবী আলী বিন সুফিয়ানকে নিজের কাছে রাখা জরুরী মনে করলেন। এ খবর পেয়ে আলী বিন সুফিয়ান ওদের পিছু নেয়া বাদ দিয়ে ছুটে এলেন আইয়ুবীর কাছে। এসেই তিনি এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, ওদের পিছু নেয়ার আর সুযোগ করে উঠতে পারলেন না।
রবিন ও মেয়েদেরকে পনেরজন সেন্ট্রির পাহারায় কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বন্দীরা চলছে উটের পিঠে প্রহরীরা ঘোড়সওয়ার। স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলেছে ওরা। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে। নির্ভয়ে চলছে কাফেলা। কোন দিক থেকে শত্রুর আক্রমণের ভয় নেই। কয়েদীরা নিরস্ত্র, সাথে ছ’টা মেয়ে। ওরা পালিয়ে যাবে সে আশঙ্কাও নেই। কিন্তু প্রহরীরা জানেনা এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। মেয়েরাও অবলা নয়, ওদেরও সামরিক প্রশিক্ষণ রয়েছে। ওদের রূপ যৌবন, মাদকতাময় দেহ এবং যে কাউকে প্রেমের ফাঁদে জড়ানোর মত অস্ত্র রয়েছে ওদের কাছে। ওদের কমাণ্ডার মিসরী।
একটা মেয়ে তার দিকে বার বার তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়লেই হাসছে মিষ্টি করে। হৃদয় গলানো হাসি।
কমাণ্ডারের মনে তোলপাড় শুরু হল। বিশ্রামের সময় খাবার দেয়া হল। মেয়েটা খাবার ছুঁলনা। কমাণ্ডারকে জানানো হল এ কথা। কমাণ্ডার মেয়েটাকে ডেকে না খাওয়ার কারণ জানতে চাইল। মেয়েটা কিছুই বলল না, কেবল মায়াময় চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
কমাণ্ডার বললেন, ‘কি ব্যাপার, তুমি খাচ্ছো না কেন?’
মেয়েটা কাঁদকে কাঁদতে বলল, ‘আমার খালী মায়ের কথা মনে পড়ে।’
মায়ের কথা শুনে কমাণ্ডারের মনটা কেমন নরম হয়ে গেল। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে খেতে পাঠাল তাকে। যাবার সময় মেয়েটা বলল, ‘কেবল আপনাকে খুশি করার জন্যই আমি এখন খাব, নইলে খাওয়ার প্রতি আমার কোন রুচি নেই।’