এ সুযোগে খৃস্টান শাসকগণ একের পর এক ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলো দখল করে নিচ্ছিল। মুসলিম শাসকবর্গ প্রজার রক্ত শুষে খৃষ্টানদেরকে বাৎসরিক কর প্রদান করত। ওদের সেনা শক্তির ভয়ে সর্বক্ষণ তটস্ত হয়ে থাকত। খৃস্টানরা মুসলমানদেরকে ভোগবিলাসের হারেমে বন্দী রেখে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব দখলের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলছিল।
সালাহউদ্দীন শিক্ষা লাভ করেছিলেন নিজাম-উল-মুলক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে শিক্ষার্থীদেরকে খালেছ ইসলামী আদর্শে গড়ে তোলার ব্যবস্থা ছিল। আর সে জন্যই ঘাতকদলের প্রথম শিকার ছিলেন নিজাম-উল-মুলক। রোমানদের রাজ্যবিস্তারে তিনি ছিলেন বড় বাঁধা। এ বাঁধা দূর করার জন্য তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
সালাহউদ্দীন এখানেই সেনা প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। প্রশাসনিক কাজে তাকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছিলেন নুরুদ্দীন জংগী। মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার সকল গুণাবলী এখানেই অর্জন করেছিলেন তিনি। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী গোয়েন্দা বৃত্তি, কমাণ্ডো অভিযান এবং গেরিলা অপারেশনকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতেন। তিনি দেখেছিলেন গুপ্তচর বৃত্তিতে খৃস্টান জগৎ অনেক অগ্রসর। মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা আর সাংস্কৃতিক অংগন ছিল ওদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। সালাহউদ্দীন অত্যন্ত ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে এর মোকাবিলা করেছিলেন।
তিনি মিসরের গভর্ণর ও সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে এলে শুরু হল ষড়যন্ত্র। বড় বড় জেনারেলরা এ পদের জন্য ছিল লালায়িত। তারা যখন দেখল তাদের আশায় গুড়ে বালি, তখনা ক্ষুব্ধ জেনারেলগণ ষড়যন্ত্র শুরু করল তার বিরুদ্ধে।
ওদের ধারনায় সালাহউদ্দীন একজন বালকমাত্র। এ পদের যোগ্যতা তার মধ্যে নেই। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে জেনারেলদের সে ধারণা ভেঙে গেল। সালাহউদ্দীন কঠোর নিয়ম শৃংখলা মেনে চলতেন। সৈন্যদের জন্য ভোগবিলাস এবং মদ নিষিদ্ধ করলেন। মনোনিবেশ করলেন ওদের শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে। ফলে অল্প দিনেই সেনাবাহিনী সুশৃংখল ও সুসংগঠিত হয়ে উঠল। অল্পবয়স্ক অর্বাচীন বালক বলে তাকে যারা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখছিল, টনক নড়ে উঠল তাদের।
সালাহউদ্দীন খৃষ্টান শক্তির মোকাবিলার জন্য একটি শক্তিশালী সেনা বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। মুক্ত ফিলিস্তিনে শ্বাস নেয়ার দুর্গম আকাঙ্খা নিয়ে সেনাবাহিনীকে সে ভাবে গড়ে তুলতে লাগলেন তিনি। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘যে খোদা আমাকে মিসরের গভর্নর করেছেন, অবশ্যই তিনি ফিলিস্তিনও মুক্ত করবেন।’ তার এ ঘোষণার জন্য কেবল খৃস্টানই নয়, খৃস্টানপন্থী মুসলমান আমীর ওমরারাও তার শত্রু হয়ে দাঁড়াল। বাইরের শত্রুর চাইতে ঘরের শত্রুরা হয়ে উঠল তার জন্য অধিকতর বিপজ্জনক।
নতুন গভর্নরের অভ্যর্থনার আয়োজন করা হল। আয়োজন করলেন জেনারেল নাজি। পঞ্চাশ হাজার ফৌজের অধিনায়ক তিনি। অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী ছাড়াও বেসামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত। মুচকি হেসে একে একে সকলের সাথে করমর্দন করলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। কণ্ঠে স্নেহ-ভালবাসার উষ্ণ পরশ। কোন কোন অফিসারের ঠোঁটে কুটিল হাসি। দৃষ্টিতে ঘৃণা আর উপহাস। ওদের ধারনা, নুরুদ্দীন জংগীর সাথে সুসম্পর্ক এবং রাজপরিবারের সন্তান বলেই সালাহউদ্দীন গভর্নর হতে পেরেছেন। এক প্রবীণ অফিসার আরেকজনের কানে কানে বলল, ‘এখনো শিশু, আমরা পেলে পুষে নেব।’
অনুষ্ঠানে তাকে শিশুই মনে হচ্ছিল। জেনারেল নাজির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন আইয়ুবী। কপাল কুঞ্চিত হল ঈষৎ। করমর্দনের জন্য হাত প্রসারিত করলেন। নাজি তোষামুদে দরবারীদের মত সালাহউদ্দীনকে কুর্নিশ করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমো খেয়ে বললেন, ‘আপনার জীবন রক্ষার্থে আমার দেহের শেষ রক্তবিন্দুটুকুও বিলিয়ে দেব। আপনি আমাদের কাছে মাননীয় জংগীর আমানত।’
‘ইসলামের চাইতে আমার জীবনের দাম বেশী নয় সম্মানিত জেনারেল।’ আইয়ুবী বললেন, ‘প্রতিটি ফোঁটা রক্ত সংরক্ষণ করে রাখুন। খৃষ্টান ষড়যন্ত্রের ঘনঘটা মুসলিম বিশ্বের আকাশে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।’
জবাবে মৃদু হাসলেন নাজি। যেন তাকে রূপ কথার গল্প শোনানো হচ্ছে। নাজি ছিল ফাতেমী খেলাফতের সিপাহসালার। পঞ্চাশ হাজার ফৌজের অধিনায়ক। সৈন্যদের সবাই ছিল সুদানের অধিবাসী। তার বাহিনী ছিল আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত। বলতে গেলে এরা ছিল নাজির ব্যক্তিগত সৈন্য। নাজি ছিল মুকুটহীন সম্রাট।
তখন মুসলিম দেশগুলোর কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না। একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছিল খৃস্টান জগৎ। মিসর এবং আশপাশের শাসকদের জন্য নাজি ছিল এক ত্রাস। তার মস্তিষ্ক ছিল ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রভূমি। ভেড়া দেখলে নেকড়ের যেমন দাঁত বেরিয়ে আসে, সালাহউদ্দীনকে দেখে নাজিরও তেমনি দাঁত বেরিয়ে এসেছিল। আইয়ুবী তার এ ক্রুর হাসির মর্ম না বুঝলেও এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, এ শক্তিধর জেনারেলকে তার প্রয়োজন।
‘হুজুর অনেক দূর থেকে এসেছেন। খানিক বিশ্রাম করে নিন।’ নাজি বলল।
‘যে কঠিন দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে, আমি তার যোগ্য নই। এ দায়িত্বভার আমার বিশ্রাম এবং নিদ্রা কেড়ে নিয়েছে। প্রথমে অফিসে গেলেই কি ভাল হয় না?’