এরপর বুঝলাম, মদপানের সাথে সাথে ওরা পাপের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। অনেক পরে কমাণ্ডারের কণ্ঠ ভেসে এল, ‘ওর এখন আমাদের প্রয়োজন নেই। জেলে পাঠিয়ে দেব, না হয় মেরে ফেলব।’
‘বরং তাকে মেরেই ফেল।’ মেয়েটার কণ্ঠ, ‘থাকলে ঝামেলা করতে পারে।’
পালানোর চিন্তা করলাম, রাতের শেষ প্রহরে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। ভোরের আলো ফোটার আগেই অনেক দূর চলে এলাম। এবার দু’দিক থেকে ধাওয়াকারীদের ভয়, খৃস্টান বা সুদানীরা পেলে হত্যা করবে, আমাদের ফৌজের কাছেও আমি অপরাধী। তাই দিনে লুকিয়ে থাকতাম কোন পড়োবাড়ীতে। দেহ এবং মস্তিষ্ক দুটোই দুর্বল।
পথ চলতাম রাতে। কখনো ইচ্ছে হতো, ফিরে গিয়ে খৃস্টান মেয়েটাকে হত্যা করি। আবার ভাবতাম, সুলতানের পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইব। কিন্তু কিছুই সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছিলাম না। এভাবে হাঁটছি, এ লোকটার সাথে দেখা। ও আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে।
সুদানীরা আক্রমণ করবে এখন এ আর আশংকা নয়, বাস্তব। সুলতানকে সংবাদ দিতে হবে, নষ্ট করার মত সময় নেই। কি করে দ্রুত সুলতানকে সংবাদ দিতে হবে, নষ্ট করার মত সময় নেই। কি করে দ্রুত সুলতানকে খবর দেয়া যায় ভাবতে লাগলেন আলী। একজন অফিসার এসে বলল, ‘সুলতান আপনাকে স্মরণ করেছেন।’
‘সুলতান!’ আলীর অবাক কণ্ঠ, ‘তিনি তো যুদ্ধের ময়দানে! এলেন কখন?’
সাথে সাথে সুলতানের সাথে দেখা করলেন তিনি। সুলতান বললেন, ‘সংবাদ পেলাম যুদ্ধের ময়দানে এবং এদিকে ওদের অনেক গুপ্তচর ছড়িয়ে পড়েছে। ওখানে আমার কাজ নেই। এ দিক নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি, তাই চলে এলাম।’
সব ঘটনা খুলে বললেন আলী। ‘সুলতান, আপনি বললে জংগীর ফৌজ আসা পর্যন্ত বিদ্রোহ মুলতবী করার চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমাদের সৈন্য কম, ওদের আক্রমণ ঠেকাতে পারব না।’ সুলতান পায়চারি করতে লাগলেন। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন তিনি। আলী অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন সুলতানে দিকে। কক্ষে নীরবতা।
হঠাৎ পায়চারী থামিয়ে সুলতান বললেন, ‘হ্যাঁ! আলী, এবার তোমার ভাষা ব্যবহার কর। আক্রমণের বিপক্ষে নয়, পক্ষে। ওরা আক্রমণ করবে রাতে, যখন ঘুমিয়ে থাকবে আমাদের ফৌজ।’
আলীর চোখে অবাক বিস্ময়। সুলতান মুখ খুললেন, ‘সব কমাণ্ডারদের ডেকে নিয়ে এস। মনে রেখ আমি এখনো যুদ্ধের ময়দানে। আমি এসেছি কেউ যেন জানতে না পারে।’
তিন রাত পর। গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে সমগ্র কায়রো। একদিন পূর্বে ফৌজকে শহরের বাইরে যেতে দেখা গেছে। বলা হয়েছে সামরিক মহড়ায় অংশ নিতে যাচ্ছে ওরা। নীলনদের পাড়ে বালিয়াড়ি আর টিলা।
টিলা এবং নদীর মাঝখানে ছাউনি ফেলল ওরা। পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্য। মাঝরাতে অশ্বক্ষুরের শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠল কায়রোবাসী। শহরের বাইরে যেন রোজ কিয়ামত। ওরা মনে করল সামরিক মহড়া।
শব্দগুলো এগিয়ে আসছে। বাড়ীর ছাদে উঠে এল উৎসুক জনতা। দিগন্তের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। দেখা গেল নীলের শান্ত বুক থেকে উঠে আসছে অগ্নিগোলক। ছাউনি লক্ষ্য করে রাতের বুক চিরে এগিয়ে আসছে তীব্র গতিতে।
শহরময় ছড়িয়ে পড়ল অশ্বক্ষুর ধ্বনি। মানুষ জানল না সুদানী ফৌজের বেশীরভাগ জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। সুলতান আইয়ুবীর কৌশল আবারো অভ্রান্ত প্রমাণিত হল। নীল আর পাহাড়ের মাঝের বালিয়াড়িতে তাঁবু ফেলল তার ক্ষুদ্র বাহিনী।
সুদানী ফৌজ দু’ভাগে ভাগ হল। মধ্যরাতে একভাগ মার্চ করল রোম উপসাগরের দিকে। সেখানে পরাজিত হয়েছে খৃস্টান বাহিনী। অন্যভাগ নীলের পাড়ের ছাউনিতে আক্রমণ করল। সুর্যোদয়ের পূবেই রাজধানী দখল করবে ওরা। দ্রুততার সাথে সুদানী বাহিনী সুলতানের ফৌজের ছাউনি দখল করল।
আচম্বিত তাঁবুতে নিক্ষিপ্ত হতে লাগল আগুনের গোলা। নীল থেকেও ছুটে আসছিল অগ্নিগোলক। তাঁবুতে আগুন ধরে গেল। অবাক হয়ে ওরা দেখল, আইয়ুবীর একজন সৈন্যও নেই তাঁবুতে।
রাতের প্রথম প্রহরেই সৈন্যদের সরিয়ে নিয়েছিলেন আইয়ুবী পাহাড়ে এবং নদীতে। ওদের দিলেন বহনযোগ্য কামান মিনজানিক। তাঁবুগুলো ভরে দিলেন তেলে ভেজা খড় এবং শুকনো ঘাস দিয়ে। সুদানী সৈন্যরা তাঁবুর কাছে এল। পাহাড় এবং নদী থেকে নিক্ষীপ্ত তোপের আঘাতে আগুন ধরে গেল শুকনো খড়ে। সুদানী ঘোড়সওয়াররা পদাতিকদের পিষে ফেলতে লাগল। চারদিকে আগুনের লেলিহান শীখা। বেরোতে গিয়ে জীবন্ত পুড়ে মরল অনেক সৈন্য। বেরিয়ে এলে পড়ত মুসলিম বাহিনীর তীরের আওতায়।
সুদানী ফৌজের অন্য দল এগিয়ে যাচ্ছিল রোম উপসাগরের দিকে। তাদের ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন সুলতান আইয়ুবী। পাহাড়ের ফাঁকে লুকিয়েছিল কমাণ্ডো বাহিনী। সুদানী ফৌজের পেছনে থেকে আক্রমণ করত ওরা। সৈন্যরা কিছু বোঝার আগেই পালিয়ে যেত। প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করে আবার এগিয়ে চলত সুদানী বাহিনী। আবার পেছন থেকে আচমকা আক্রমণ।
অন্ধকার রাত। এ অন্ধকারে কমাণ্ডোদের ধাওয়া করা অসম্ভব। ভোর পর্যন্ত তিনবার আক্রান্ত হল ওরা। ভয় পেয়ে থেমে গেল ফৌজ। সামনে এগিয়ে যাবার সাহস হারিয়ে ফেলেছে ওরা।
দিনের বেলা কমাণ্ডাররা তাদের বোঝাল। সাহস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল সৈন্যদের। রাতে আবার আক্রমণ হল। অদৃশ্য শত্রুর তীরের আঘাতে মারা পড়ল অসংখ্য সৈন্য। হঠাৎ মাল বোঝাই উটগুলো দিকবিদিক ছুটতে লাগল। মাঝ পথে আগুন জ্বলছে। মাত্র দু’রাতের কমাণ্ডো আক্রমণে সুদানী বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল। সৈন্যদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে দিল আলীর গোয়েন্দারা। আরব থেকে বিশাল বাহিনী আসার সংবাদে ভয় পেয়ে গেল ওরা। যে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল।