মুসলিম শাসকরা খৃস্টান এবং ইহুদী যুবতীর রূপের হারেমে বন্দী। উপদেষ্টাদের বেশীরভাগ ইহুদী বা খৃস্টান। ভোগ আর সুরার অন্ধাকারে হারিয়ে গিয়েছিল ওদের বিবেক।
ওদেরকে হারেমের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করবেন আইয়ুবী, জাগিয়ে তুলবেন জাতির বিবেক, জেগে উঠবে মানবতা, এ অসহ্য। শেরে কোহ-এর শাসন থেকে ওরা বুঝেছিল, সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তাদেরকে ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করবেন। তাই তার সব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে চাচ্ছিল ওরা। এ জন্য সাহায্যের আশায় হাত বাড়াল খৃস্টানদের কাছে। ওরা ময়দান উর্বর করছির খৃস্টান গোয়েন্দাদের জন্য।
নুরুদ্দীন জংগী না হলে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ইতিহাস হয়ত অন্যভাবে লেখা হত। বিশ্বের মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যেতনা এতগুলো মুসলিম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব।
আলীর চিঠি পেলেন নুরুদ্দীন জংগী। ঘোড়সওয়ার এবং পদাতিক মিলে দু’হাজার সৈন্য পাঠালেন আইয়ূবীর সাহায্য।
নাজির মৃত্যু সংবাদ পৌঁছে গেল সুদানী সেনা শিবিরে। সুলতান যুদ্ধের ময়দানে, মিসরে রয়েছে অল্প ক’জন সৈন্য, আক্রমণের সুবর্ন সুযোগ। মিসরের সেনা ছাউনিতে হঠাৎ আক্রমণ করা হবে এ সিদ্ধান্ত নিল ওরা।
মিসরে পৌঁছল আলীর ক্ষুদ্র কাফেলা। মুবি এবং ফখরুলকে পাওয়া যায়নি। সুদানী হেড কোয়ার্টারে নিয়োজিত গোয়েন্দাদের ডেকে পাঠালেন তিনি এক গোপন আস্তানায়। ওদের একজন বলল, ‘গতরাতে একটা উট এসেছে। আরোহী একজন পুরুষ ও এক যুবতী।’
‘কোথায় উঠেছে ওরা?’
ওরা কোথায় উঠেছে গোয়েন্দা তার বিশদ বর্ণনা দিল। সুদানীরা মুসলিম ফৌজেরই অংশ, ইচ্ছে করলে আলী যে কারো বাসায় তল্লাশী নিতে পারেন। এতে আগুনে ঘি ঢালা হবে। আরও ক্ষেপে যাবে সুদানী ফৌজ। মুবিকে গ্রেফতার করা তার আসল উদ্দেশ্য নয়, তার উদ্দেশ্য ওদের পরিকল্পনা জানা। নতুন নির্দেশ দিয়ে গোয়েন্দাদের ফেরত পাঠালেন তিনি।
চারদিন পর্যন্ত রাজধানীর বাইরে ঘোরাঘুরি করলেন আলী। পঞ্চম রাতে খোলা আকাশের নীচে বসে আছেন তিনি। বিশ্রাম করছেন আর ফাঁকে ফাঁকে শুনছেন গুপ্তচরদের রিপোর্ট।
এক গোয়েন্দা একটা লোককে ধরে নিয়ে এল। পা কাঁপছিল লোকটির, পড়ে যাচ্ছিল বারবার। গোয়েন্দা বলল, ‘ওর নাম নাকি ফখরুল মিসরী, জড়ানো কণ্ঠে ও শুধু বলছে আমাকে আমার সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছে দাঁও।’
ফখরুল গোয়েন্দা প্রধানের সামনে বসল।
‘একটা মেয়ে নিয়ে যে পালিয়ে এসেছে তুমি কি সেই কমাণ্ডার?’
‘আমিই সুলতানের রক্ষী বাহিনীর সেই পলাতক আসামী। মৃত্যুদণ্ডই আমার প্রাপ্য। তবে আমাকে মারার আগে আমার কথা শোন, নয়ত তোমরা সবাই মরবে।’
আলী বুঝলেন, কমাণ্ডারের এখনও নেশা কাটেনি। তাকে অফিসে নিয়ে গেলেন। পথে পাওয়া খাবারে থলে দেখিয়ে বললেন, ‘এটা কি তোমার? এখান থেকে কে খেয়েছে?’
‘হ্যাঁ, ও আমাকে এ থেকে খাইয়েছে।’
আলী থলে খুললেন। গুড়ের মত একটা টুকরা বেরিয়ে এল। এক ঝটকায় টুকরাটা হাতে তুলে নিল ফখরুল। মুখে দেওয়ার আগেই আলী তার হাত ধরে ফেললেন।
‘দোহাই আপনার, ছেড়ে দিন। এর ভেতর আমার জীবন, আমার আত্মা।’
‘আগে সব কথা খুলে বল। এরপর এর সবই তোমার।’
কমাণ্ডারকে এন্টি ড্রাগ খাওয়ানো হল। কিছুটা প্রকৃতিস্থ হলে গোটা কাহিনী বলল সে।
‘ব্যবসায়ীরা আমাকে কফি পান করাল। মনে হল অন্য পৃথিবীতে পৌঁছে গেছি আমি। মেয়েটা আমাকে ভালবাসার কথা বলল, লোভ দেখাল বিয়ের। আমরা দু’জন উটে সওয়ার হলাম।
পথে ধরা পড়ার ভয়ে বিশ্রাম করেছি কম। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করত। আমার পাশবিক সত্তা জেগে উঠলে বলত, এখন নয়, বিয়ের পর ওসব হবে। উটের সাথে খাদ্যের দুটো ব্যাগ, একটা থেকে ও খেত, আমাকে দিত অন্যটা থেকে। পথে থলে দু’টো কোথাও পড়ে গেল। খোঁজ করার জন্য পীড়াপীড়ি করল ও, আমি রাজি হইনি। বলেছি সময় নষ্ট হলে ধরা পড়ে যাব। খাবারের অভাব হলো, কিন্তু বসতি থেকে দূরে থাকতে চাইত ও।
চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় আমরা এক সুদানী কমাণ্ডারের কাছে পৌঁছলাম। আমার মাথায় অসংখ্য কীটের দংশন। কেন জানিনা, ধীরে ধীরে প্রকৃতিস্থ হলাম। মেয়েটা আমার সামনেই কমাণ্ডারকে সব কথা বলল। প্ররোচিত করতে লাগল বিদ্রোহ করার জন্য। বলল, আলী এবং আইয়ূবীর মাঝে ভুল বুঝাবুঝীর সৃষ্টি করতে হবে। তাদের দীর্ঘ আলোচনায় বিদ্রোহের কথাই প্রাধান্য পেয়েছে। তথোক্ষণে আমি পুরোপুরি সুস্থ।
আবার মাথার যন্ত্রণা, আবার সুস্থ, এভাবে চলতে লাগল। মেয়েটা কমাণ্ডারকে বলল, আইয়ুবী নেই, এখনি বিদ্রোহ করার উপযুক্ত সময়। ও আরও বলল, কিছু দিনের মধ্যেই খৃস্টান সৈন্যরা আবার আক্রমণ করবে। তখন আইয়ুবীকে এখানকার ফৌজও ডেকে নিতে হবে। কমাণ্ডার তার কথায় সম্মত হয়ে বলল, ছ’ সাত দিনের মধ্যেই তারা বিদ্রোহ করবে।
মাঝ রাতে আমাকে অন্য এক কামরায় পাঠিয়ে দেয়া হল। দু’কক্ষের মাঝে ছোট একটি দরজা। দরজাটি ওপাশ থেকে বন্ধ।
কমাণ্ডার এবং মেয়েটা হাসির শব্দ ভেসে আসছিল ও পাশ থেকে। আমার ঘুম আসছিল না। উঠে দরজায় কান লাগিয়ে উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। মেয়েটা বলল, ‘ওকে হাশিশ খাইয়ে এদ্দুর এনেছি। একা এতদূর আসা সম্ভব ছিল না বলে পথে ছিলাম ওর প্রেমিকা। পথে হাশিশের পুটলিটা পড়ে গেছে। সকালে এক পুরিয়া না পেলে বিরক্ত করবে।