টিলার কাছে গেলেন গোয়েন্দা প্রধান। বালিতে পায়ের ছাপ সুস্পষ্ট। একটা সৈনিক বুটের ছাপ, অন্যটা মেয়েলী জুতো। মেয়েলী জুতার চিহ্ন ধরে আহত বন্দীদের তাঁবু পর্যন্ত চলে এলেন আলী। তাঁবুর পর্দা তুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। শুয়ে আছে পাঁচজন, একজন বসা। আলীকে দেখেই সে শুয়ে কাৎরাতে লাগল। আলী তার কাঁধ খামচে ধরে বাইরে নিয়ে এলেন।
‘রাতে একটা মেয়ে তোমার কাছে এসেছিল কেন?’
রবিন হাবার মত তাকিয়ে রইল। যেন এসব কথা সেকিছুই বুঝতে পারছে না। আলী তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমি তোমার ভাষা বুঝি। কিন্তু তোমাকে আমার ভাষাতেই কথা বলতে হবে।’
রবিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ‘ওকে এখানে বসিয়ে রাখ।’ প্রহরীকে বলে আবার তাঁবুর ভেতরে ঢুকলেন আলী। বন্দীদের বললেন, ‘কাল রাতে মেয়েটা কতক্ষণ এখানে ছিল? নিজেদের যন্ত্রণার মধ্যে ফেলো না, জলদি জবাব দাও ও কার কাছে এসেছিল?’
সাগরের উত্তাল তরঙ্গের সাথে লড়াই করে ওরা বেঁচে আছে। দেখেছে মৃত্যুর বিভীর্ষিকা। অথচ গোয়েন্দা প্রধানের একা কড়া ধমক খেতেই একজন বলে উঠল, ‘ও এসেছিল রবিনের কাছে। শুয়েছিল কি বসেছিল অন্ধকারে দেখা যায়নি। কি বলেছে তাও শুনিনি। মেয়েটা যে কে তাও জানিনা। রবিনের পদমর্যাদা সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ, আমরা শুধু তার নাম শুনেছি। এখানে আসরা আগমুহূর্ত পর্যন্ত সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল ও। আমরা সাবই সাধারণ সৈনিক। আমাদের ওপর রহম করুন।’
ওদের ওপর করা দৃষ্টি রাখতে বললেন প্রহরীদের। ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছলেন তিনি। রক্ষীরা ওদের তাঁবুর সামনে বসিয়ে রেখেছে। রক্ষীরা বলল, ‘কাল দু’টো উট দেখেছি, আজ একটা নেই।’
গোয়েন্দা প্রধানের জন্য এটা একটা মূল্যবান সংবাদ। ওদের জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু সন্তোষজনক জবাব দিতে পারল না ওরা। উটের পায়ের চিহ্ন পাওয়া গেল। আলী বললেন, ‘তোমরা সাধারণ চুরির অপরাধে অপরাধী নও। তোমরা একটা দেশ এবং একটা জাতির জন্য বিপজ্জনক। ক্ষমা তোমাদের করা যায় না। তোমরা কি ব্যবসায়ী?’
‘হ্যাঁ।’ সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল। ‘আমরা ব্যবসায়ী, আমরা নিরপরাধ।’
সবাই হাতের উল্টো পিঠ দেখাও।’
হাত উল্টে এগিয়ে ধরল ওরা। বাঁ হাতের তর্জনী এবং মধ্যমার মাঝখানটা দেখলেন আলী। একজনের হাতের কব্জি ধরে বললেন, ‘তীর কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?’
ওরা না জানার ভান করল। সুলতানের এক দেহরক্ষীকে ডাকলেন আলী। উল্টো করলেন তার হাত। বললেন, ‘এ লোকটি আমাদের তীরন্দাজ। ওর দু আঙ্গুলের ফাঁকে তীরের ঘর্ষণের চিহ্ন রয়েছে। ধনুকে তীর জুড়ে নিক্ষেপের সময় তর্জনী এবং মধ্যমার ফাঁক দিয়ে তীর ছুটে যায়। তীরন্দাজ ছাড়া অন্য কারো এ চিহ্ন থাকেনা। পাঁচজনের মধ্যে কেবল তোমার আঙ্গুলে এই চিহ্ন রয়েছে। এবার বল তীর কোথায়?’
পাঁচজনই নীরব। ওদের একজনকে ধরে রক্ষীকে বললনে, ‘একে ওই গাছের সাথে বেঁধে দাও।’
তারপর অন্য এক রক্ষীকে ডেকে কানে কানে কিছু বললেন। রক্ষী লোকটাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল। বিঁধল ডান চোখে। তড়পাতে লাগল লোকটা।
‘ক্রুশের জন্য এভাবে আর কে জীবন দিতে পার? একে দেখ, তড়পাচ্ছে। রক্ত ঝরছে চোখ থেকে। কথা দিচ্ছি, তোমাদের সসম্মানে সাগরের ওপারে পাঠিয়ে দেব। বল দ্বিতীয় উট কে নিয়ে গেছে? কোথায় গেছে?’
‘তোমাদের এক কমাণ্ডার আমাদের একটি উট ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।’
‘সাথে একটি মেয়েও।’ আলীর কণ্ঠে বিদ্রুপ।
শেষতক স্বীকার করল ওরা। শোনাল সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী সম্পর্কে মেয়েটার বলা মিথ্যা কাহিনী। কিন্তু তাঁবু থেকে পালিয়ে আসাটা চেপে গেল।
আলীর ঠোঁটে শ্লেষের হাসি।
‘আশ্চর্য! একজন মাত্র লোক তোমাদের মত পাঁচজন সৈনিকের কাছ থেকে একটা উট এবং একটা মেয়ে ছিনিয়ে নিয়ে গেল?
তীর ধনুক বের করা হল বালির নীচ থেকে। তড়পাতে তড়পাতে মরে গেল তীর খাওয়া লোকটা।
দশজন অশ্বারোহী ডেকে দ্রুত উটের পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে যেতে বললেন গোয়েন্দা প্রধান। ওদের যাবার পনের ঘন্টা পর তাদের পিছু ধাওয়া করে ছুটল আলীর বাহিনী।
খাওয়া এবং বিশ্রাম ছাড়া উট একনাগাড়ে ছ’সাত ঘন্টা চলতে পারে। ধরা পড়ার ভয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল ফখরুল। মরুর জাহাজ উটও তার সহযোগিতা করছিল।
পথে দুজায়গায় উট বসার চিহ্ন পাওয়া গেল। পাশে খেজুরের বীচি, ফলের খোসা। আরো কিছুটা এগিয়ে আলী খাবার রাখার দু’টো থলে কুড়িয়ে পেলেন। একটা খালি, অন্যটাতে তখনও বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্য অবশিষ্ট ছিল। খাবারগুলো নাকের কাছে নিতেই পরিচিত একটা গন্ধ নাকে লাগল। আলী বললেন, ‘এ খাবারে হাশিশ মেশানো।’
থলে দু’টো নিয়ে আবার চলতে লাগল কাফেলা। বিচক্ষণ আলী সময় নষ্ট না করে কাফেলাকে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে চললেন।
ফখরুল মিসরী এবং মুবি ধরা পড়লেও কিছু যায় আসে না। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে সুদানী সেনাবাহিনীকে নতুন করে প্ররোচিত করার কিছু ছিল না। মুবির প্ররোচনা ছাড়াই আইয়ুবীর বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ ভরা ছিল ওদের হৃদয়গুলো। এ বিষ ওদের পান করিয়েছিল নাজি। ফাতেমী খেলাফতের সেনাপতিরা ছিল নামে মাত্র জেনারেল। ওরা ছিল অকর্মণ্য ও বিলাসপ্রিয়। আইয়ুবীকে অথর্ব প্রমাণ করতে চাইছিল ওরাও।