নাজি এবং তার সংগীদের যে গোপনে হত্যা করা হয়েছিল এ কথা জানতো না এরা। মুবি চাচ্ছিল দ্রুত নাজির কাছে পৌঁছতে, কিন্তু এক যুবতীর পক্ষে একা মিসর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব ছিল না। অপ্রত্যাশিত ভাবে ফখরুলকে পাওয়ায় তার বরং সুবিধাই হল। ওরা সিদ্ধান্ত নিল, মিসর যাওয়ার পথে ওকেই ব্যবহার করা হবে।
খৃষ্টান গোয়েন্দা দলে প্রধান রবিন রয়েছে আহতদের তাঁবুতে। ব্যবসায়ীরাও সিদ্ধান্ত নিল এখানেই থাকবে। আইয়ুবীকে ছোঁড়া তীর একবার ফসকে গেছে, আবার চেষ্টা করবে ওরা।
মুবির রূপের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে ফখরুল। হাশিশ তাকে বিবেকশূন্য করে দিয়েছে। ফখরুল আর নিজের তাঁবুতে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
মুবিকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ার জন্য তাকে পরামর্শ দিল ক্রিস্টোফার। ব্যবসায়ীরা একটা উট দিল তাকে। উটের সাথে দেয়া হল পানির মশক ও প্রয়োজনীয় খাবার। হাশিশ মেশানো খাবারের থলিটা ধরিয়ে দিল মুবির হাতে। ফখরুল পরল ঢাউস জুব্বা ও ব্যবসায়ীদের মত টুপি। উটের পিঠে চাপল মুবি ও কমাণ্ডার।
উট চলতে শুরু করেছে, আশপাশের কোন খেয়াল নেই কমাণ্ডারের। সমস্ত অতীত তার হারিয়ে গেছে। হৃদয়ের কার্নিশে এখন শুধু ঝুলে আছে বিশ্বের সেরা এক সুন্দরীর ছবি। সুলতানকে বাদ দিয়ে যে রূপসী তাকে পছন্দ করেছে। কি সৌভাগ্য তার, মুবিকে বাহুবেষ্টন করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল ও।
‘খৃস্টান কমাণ্ডার আর তোমাদের সুলতানের মত পশুর আচরণতো করবে না?’ কপট কটাক্ষ হেনে বলল মুবি।
‘মুবি, আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি সে কথা কি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।’
‘না ফখরুল, এ তো আমি রহস্য করে বলেছি। তোমার ভালবাসার ওপর আমার আস্থা না থাকলে কি তোমার সাথে এভাবে একাকী বেরিয়ে পড়তাম? এ দেহ-মন আমি তোমাকেই সঁপেছি। এখন থেকে আমি শুধুই তোমার। আমাকে নিয়ে তোমার যা ইচ্ছে করতে পার। তবে আইয়ুবীর পশুত্ব ভুলতে পারছি না বলেই ওভাবে বলেছি তোমায়। ধৈর্যহীনদের আমি ঘৃণা করি, যেমন ঘৃণা করি তোমাদের সুলতানকে।’
‘তার মানে তুমি আমাকে ধৈর্যহীন বলতে চাইছো? দেখ মুবি, তুমি চাইলে আমি উট থেকে নেমে যাব।’ মুবিকে বাহুবন্ধন থেকে ছেড়ে দিল ফখরুল।
‘ছি! কি বলছো তুমি? তোমাকে আমার ভাল লেগেছে বলেই তো তোমার জন্য আমার ধর্ম পর্যন্ত ত্যাগ করেছি। ইচ্ছে করলে আমি ব্যবসায়ীদের কাছেও তো থাকতে পারতাম।’
মুবির আগেবপূর্ণ কথায় আরো দুর্বল হয়ে পড়ল কমাণ্ডার। গল্পে গল্পে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে ওরা।
সাধারণভাবে চললে ওদের পাঁচদিনের পথ অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু ফখরুল এক পালিয়ে আসা সৈনিক। মুবিও পালিয়ে এসেছে মুসলিম তাঁবু থেকে। তাই সাধারণ পথ ছেড়ে দুর্গম পথে এগিয়ে চলল ওরা।
গভীর হয়ে এল রাত। ঘুমে ভারী হয়ে এল মুবির চোখ। ফখরুলের বুকে মাথা রেখে ও ঘুমিয়ে পড়ল। আকাশের অগণিত তারার রাথে জেগে রইল এক পলাতক সৈনিক। উট এগিয়ে চলছে মিসরের দিকে।
সবেমাত্র ফজরের নামাজ শেষ করেছেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, প্রহরী তাঁবুতে প্রবেশ করে জানাল, ‘আলী বিন সুফিয়ান এসেছেন।’
তাঁবু থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলেন সালাহউদ্দীন। আলীর সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও দিকের কি খবর?’
‘এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক। তবে ওদের উৎকণ্ঠা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের গোয়েন্দারা বলেছে, নেতৃত্ব দেয়ার মত কোন কমাণ্ডার এগিয়ে এলে ওরা বিদ্রোহ করবে।’
কথা বলতে বলতে দু’জন তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। ‘নাজি এবং তার সংগীদের আমরা শেষ করেছি, কিন্তু সুদানীদের ভেতর মিসরীয়দের বিরুদ্ধে যে বিষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তার প্রভাব এখনও কমেনি। সেনাপতির অন্তর্ধান তাদের উৎকণ্ঠার বড় কারণ। আমাদের গোয়েন্দারা প্রচার করেছে যে, নাজি যুদ্ধের ময়দানে। আমার মনে হয় ওরা একথা বিশ্বাস করছে না।’
‘ওরা বিদ্রোহ করলে আমাদের ওখানকার ফৌজ কি অভিজ্ঞ পঞ্চাশ হাজার ফৌজের মোকাবিলা করতে পারবে?’
‘আমি তার ব্যবস্থা করে এসেছি। সব জানিয়ে দু’জন ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে দিয়েছি নুরুদ্দীন জংগীর কাছে। বিদ্রোহ দমন করার জন্য কিছু সাহায্য পাঠাতে অনুরোধ করেছি তাকে।’
‘ওদিক থেকে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা কম। গত পরশু দূত মারফত জেনেছি, জংগী সম্রাট ফ্রাংকুর এলাকা আক্রমণ করেছেন। খৃস্টানদের বিশাল এক বাহিনী মিসরের দিকে আসছিল। আক্রান্ত হয়ে পিছনে সরে গেছে ওরা। জংগী কিছু এলাকাও দখল করেছেন। কিন্তু একটা সংবাদে আমি দারুণ উদ্বিগ্ন।’
‘ওরা আবার হামলা করেছে?’
‘ওদের আক্রমণে আমি ভীত নই। আমার উদ্বেগের কারণ হল, শত্রুকে যারা বাঁধা দেবে তারা মদের পিয়ালায় আকণ্ঠ ডুবে আছে। ইসলামের রক্ষকরা হারেমে বন্দী। যুবতী নারীর মোহনীয় চুল ওদের পায়ে শৃংখল পরিয়ে রেখেছে।
হায়, আমার চাচা শেরে কোহ আজ যদি বেঁচে থাকতেন! তিনিই আমাকে যুদ্ধের ময়দানে এনেছিলেন। সামান্য সৈন্য নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শত্রুর ওপর। কিন্তু মুসলিম নামধারী বেঈমানের দল শত্রুর সাথে মিশে গিয়েছিল। তার সামনে তৈরী করেছিল দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর। তবু চাচা সাহস হারাননি। তুমিতো তার সব ইতিহাস জান।’
‘আমার সব কিছু মনে আছে সুলতান। সে সব যুদ্ধ এবং রক্তঝরার পর আশা করেছিলাম মিসর এবার সোজা পথে আসবে। কিন্তু এক গাদ্দারের মৃত্যু হলে এগিয়ে আসে অন্য গাদ্দার। আসলে গাদ্দার দুর্বল খেলাফতের সৃষ্টি, ফাতেমী খেলাফত হারেমের বিলাসে হারিয়ে না গেলে খৃস্টানদের সাথে আপনার যুদ্ধ এখানে নয়, ইউরোপে হত। আমাদের বন্ধুরাই আমাদেরকে বাইরে যেতে দিচ্ছে না। শাসক যখন ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে প্রজারা তখন সিংহাসের স্বপ্ন দেখে, সাহায্য চায় শত্রুর কাছে। ক্ষমতার লোভে তাদের স্ত্রী কন্যার ইজ্জত আব্রুর কথাও ভুলিয়ে দেয়।’