অত্যাধিক মদপান করায় সুলতান বেহুশ হয়ে পড়ল। এ সুযোগে আমি পালিয়ে এসেছি। বিশ্বাস না হলে তার দেহরক্ষীদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পার।’
মুবির কথার মাঝেই কফি পরিবেশন করা হল। কফির মধ্যে হাশিশ মেশানো ছিল জানতো না কমাণ্ডার। কফি পান করল কমাণ্ডার, হাশিশের ক্রিয়া শরু হল মগজে। মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে অট্টহাসি দিয়ে বলল, ‘আমাদের জন্য নির্দেশ, মদ এবং নারী থেকে দূরে থাক। নিজে মেয়ে মানুষ নিয়ে ফুর্তি করছে আর মদ পান করছে, হা, হা, হা। ‘
হাশিশের প্রভাবে ও বুঝতেই পারল না মেয়েটা নির্জলা মিথ্যে বলেছে তার সাথে। কল্পনায় এখন সে নিজেই সম্রাট। মুবির চেহারায় মশালের আলো। চুলে কাল আর সোনালী রঙের মিশেল। যৌবন উপচে পড়ছে অপরূপা অঙ্গ থেকে। চোখে নেশা ধরানো দীপ্তি। কমাণ্ডারের মনে হল, পৃথীবির সবচেয়ে রূপবতী নারীটি বসে আছে তার সামনে।
সে চঞ্চল হয়ে বলল, ‘তুমি চাইলে আমি তোমাকে আশ্রয় দিতে পারি।’
‘না?’ ভয়ে পেছনে সরে গেল মুবি। ‘তুমিও আমার সাথে সুলতানের মতই আচরণ করবে। তোমার তাঁবুতে নিয়ে গেলে আবার আমি আইয়ুবীর হাতে গিয়ে পড়ব।’
‘ইজ্জত রক্ষার জন্য ওদেরকে তোমাদের হাতে দেয়া ভুল হয়ে গেছে। ভাবছি অন্য মেয়েদেরকেও কালই গিয়ে ফেরত নিয়ে আসব। বলল এক ব্যবসায়ী।
মুবির দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়েছিল ফখরুল মিসরী। তার দেহলতা ও শরীরের প্রতিটি অঙ্গ থেকে উপচে পড়ছে যৌবন। এমন অপরূপা অঙ্গশোভার অধিকারী সুন্দরী নারী সে জীবনেও দেখেনি।
ব্যবসায়ীর কথা পিঠে কেউ কোন কথা বলল না। তাঁবুতে নেমে এল নীরবতা। চুপচাপ কেটে গেল কিছু সময়।
নীরবতা ভাঙল ক্রিস্টোফার। বলল, ‘তুমি আরবী না মিসরী?’
‘মিসরী। আমি সাধারণ একজন সৈনিক হিসাবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলাম। যুদ্ধে বীবরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় আমাকে কমাণ্ডার পদে প্রমোশন দেয়া হয়েছে।
‘সুদানী ফৌজকে দেখছি না, ওরা কি এ যুদ্ধে অংশ নেয়নি?’
‘সুদানী কোন ফৌজ এখানে আসেনি, এ যুদ্ধে অংশ নেয়নি ওরা।
‘কি ব্যাপার, যুদ্ধে ওরা অংশ নিল না কেন?’
‘মনে হয় সুদানীরা সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে গ্রহণ করেননি।’ জবাব দিল আরেক ব্যবসায়ী।
‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। সুদানীরা সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে গ্রহণ করেনি। তাদের কমাণ্ডার সুলতানকে মিসর ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। কারণ তিনি মিসরের নন, বিদেশী। এ জন্য আইয়ুবী মিসরীয়দের দিয়ে নতুন ফৌজ গঠন করেছেন। ওরাই এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।
গল্প জমে উঠেছে। যেন খোশগল্প করছে সবাই এভাবেই একজন জানতে চাইল, ‘যুদ্ধে তো তোমরা জিতেছ, গনিমতের মাল কি কি পেলে?’
‘গনিমতের মাল কি আর গরীবের ভাগ্যে জোটে!’ টিপ্পনি কাটল অন্যজন।
‘গনিমতের মালের খবর জানিনা, এখনো ভাগবণ্টন হয়নি বোধ হয়।’ বলল কমাণ্ডার।
‘তা জানবে কেমন করে? তোমাদের সুলতান তোমাদেরকে মদ ও নারী থেকে দূরে থাকতে উপদেশ দেন, অথচ নিজে ভোগ বিলাসে মত্ত থাকেন। যুদ্ধলব্ধ সম্পদের খবর তোমরা যারা যুদ্ধ করেছ তারা জাননা, অথচ ব্যবসায়ী হিসাবে আমরা জানি, খৃস্টান জাহাজ থেকে অঢেল সম্পদ পাওয়া গেছে। অসংখ্য উট বোঝাই করে এসব মাল কায়রো পাঠানো হয়েছে রাতের অন্ধকারে। কায়রো থেকে সে সব চলে যাবে দামেশক এবং বাগদাদ। সুদানী ফৌজকে সুলতান দাসে পরিণত করতে চাইছেন। আরবের সৈন্য এসে গেলে তোমরাও হবে তাদের মতই গোলাম।’
মুবির চোখ ধাঁধানো রূপ আর হাশিশের প্রবাবে ফখরুলের হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছিল ওদর প্রতিটি শব্দ। অযাচিত ভাবেই পরিস্থিতি মুবির পক্ষে চলে গেছে। তাকে ধরতে এসে নিজেই ফেঁসে গেছে কমাণ্ডার।
আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানত না কমাণ্ডার। মুবি নিজের ভাষায় সব ঘটনা বলতে লাগল সংগীদের। ওদের শোনাল রবিনের নির্দেশ। বলল, ‘পরাজয়ের কারণ বের করতে হবে। যেতে হবে নাজির কাছে।’
মেয়েটা কি বলছে জানতে চাইল ফখরুল। ক্রিস্টোফার বলল, ‘ও বলছিল, তুমি আইয়ুবীর সৈন্য না হলে ও তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হতো। এ জন্য ও মুসলমান হতেও প্রস্তুত। কিন্তু এখন সে কোন মুসলমানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।’
কমাণ্ডার কি ভেবে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। মুবির হাত ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করে বলল, ‘খোদার শপথ তোমার জন্য আমি সিংহাসন ত্যাগ করি এই যদি হয় তোমার ইচ্ছে, এই রইল তরবারী! এখন থেকে তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।’
কমাণ্ডার খাপ সহ তার তরবারী রেখে দিল মুবির পায়ের কাছে। ‘এখন আমি আইয়ুবীর সৈনিক নই, কমাণ্ডারও নই।’
মুবি হাত ধরে টেনে ওকে পাশে বসাল। নিজেও ঘনিষ্ট হয়ে বলল তার পাশে। বলল, ‘তুমি যদি সত্যি আমাকে চাও তোমার জন্য আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করবো। তবে আমাকে পেতে হলে তোমাকে একটা শর্ত পালন করতে হবে, যে পাষণ্ড পশু আমার ওপর আজ এ বর্বর আচরণ করেছে, তার প্রতিশোধ নিতে হবে তোমাকে।’
‘খোদার কসম, সুলতান আমার হাত থেকে কিছুতেই রক্ষা পাবে না। একে আমি খুন করবো।’
মুবি ব্যবসায়ীদের দিকে তাকাল। ক্রিস্টোফার বলল, ‘এক আইয়ুবী মরলে বা বাঁচলে কিছু যায় আসে না। যে আসবে সেও এমন হবে। আজ হোক, কাল হোক মিসরীরা ওদের দাসই হবে। তুমি বরং নাজির কাছে যাও। মুবি থাকবে তোমার সংগে। তোমরা দু’জন সালাহউদ্দীনের আসল রূপ তার কাছে প্রকাশ করে তার সাহায্য চাইতে পার। এ ছাড়া এর বদলা নেয়ার কোন রাস্তা দেখি না আমি।’