মেয়েটা হাঁটা শুরু করতেই কমাণ্ডার টিলার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, ‘কে তুমি, নীচে নেমে এস।’
চঞ্চল হরিণীর মত মেয়েটা দ্রুত টিলার অন্যদিকে নেমে গেল।
কমাণ্ডার একলাফে টিলার ওপর উঠে এল। রাতের নীরবতা ভেঙ্গে তীব্রগতিতে ছুটছে মেয়েটা। তাকে ধরার জন্য তার পিছনে ছুটল কমাণ্ডার।
দু’জনের মাঝে বেশ খানিকটা দুরুত্ব। দু’জনেই ছুটছে তীব্র গতিতে। কিন্তু ফখরুল একজন সৈনিক, ছুটছে চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতা নিয়ে। অসমতল মাটি, শুকনো ঝোপঝাড় আর গাছগাছালি মাড়িয়ে নিশুতি রাতে মরুদ্যানের বুকে ছুটছে দু’জন। দূরত্ব কমে আসছে দু’জনের মাঝে। সামনে খণ্ড খণ্ড অনেকগুলো এলোপাথারি ঝোপঝাড়।
মুবি মেয়ে হলেও একজন গোয়েন্দা। শত্রুর চোখে ধুলো দেয়ার হাজারো কায়দা কানুন শিখেছে দীর্ঘদিনের অনুশীলনে। তার সে ট্রেনিং কাজে লাগানোর সময় এসেছে। দ্রুত ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করল মুবি। কমাণ্ডার কিছুদূর এগিয়ে দেখল সামনে কেউ নেই। মেয়েটার পায়ের শব্দও শোনা যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল সে। গতি কমিয়ে অনির্দিষ্টভাবে এগিয়ে গেল সামনে।
গাছের আড়ালে লুকিয়ে কমাণ্ডারকে এগিয়ে যেতে দেখল মুবি। কমাণ্ডার এগিয়ে যেতেই ও আবার ছুটতে লাগল। হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ শুনে কমাণ্ডারও ছুটল পেছন ফিরে। আবার কোন শব্দ নেই। অনুমান করে ছুটছে কমাণ্ডার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পেছন থেকে আবার ভেসে এল পদশব্দ। ঘুরে দৌড় লাগাল কমাণ্ডার। থেমে গেল পদশব্দ লুকোচুরি খেলার ট্রেনিং ভালই কাজে লাগাচ্ছে মুবি। ‘
এভাবে চলল কিছুক্ষণ। মেয়েটা যেন তার সাথে কানামাছি খেলছে। হারিয়ে যাচ্ছে, আবার দৌঁড়াচ্ছে। ক্রোধে ফুঁসতে লাগল কমাণ্ডার।
ঝোপ ঝাড় আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে এভাবে লুকোচুরি খেলতে খেলতে মাইল দুয়েক দূরে চলে এসেছে ওরা। সামনে দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের তাঁবু।
মেয়েটা তাঁবুর কাছে পৌঁছে চিৎকার করে ডাকতে লাগল ওদের। আলো জ্বেলে তাঁবু থেকে বরিয়ে এল ব্যবসায়ীরা।
তরবারী হাতে কমাণ্ডারও পৌঁছে গেল ওখানে। ব্যবসায়ীদেরকে মুসলমান মনে হচ্ছে। মেয়েটা তাদের একজনের পা জড়িয়ে ধরে আছে। আতংকে বিবর্ণ চেহারা, হাফাচ্ছে।
‘এ মেয়েটাকে আমার হাতে তুলে দাও।’ নির্দেশের ভংগীতে বলল কমাণ্ডার।
‘ও একা নয়,’ বলল এক ব্যবসায়ী, ‘আমরা সাতজনকেই তোমাদের সুলতানের কাছে দিয়ে এসেছি, একেও নিয়ে যেতে পার।’
‘না।’ আরও জোরে লোকটার পা আকড়ে ধরল মুবি। বলল ‘আমি ওর সাথে যাব না। মুসলমানরা খ্রীস্টানের চাইতেও জানোয়ার। ওদের সুলতান একটা ষাঁড়, একটা পশু। সে আমার হাড়গোড় পর্যন্ত ভেঙে দিয়েছে। আমি কোন রকমে পালিয়ে এসেছি।’
‘কোন সুলতান?’ কমাণ্ডারের হতবাক কণ্ঠ।
‘যাকে তোমরা সালাহউদ্দীন আইয়ুবী বল।’
‘মেয়েটা মিথ্যে বলছে। কে ও? তোমাদের সাথে এর সম্পর্ক কি?’
‘ভেতরে এস বন্ধু। বাইরে ঠাণ্ডা, তরবারী খাপে ঢুকাও। কোন ভয় নেই, আমরা ব্যবসায়ী। মেয়েটা কি বলতে চায় শোনই না। আমরা তোমাদের সুলতানকে ভাল মানুষ ভেবেছিলাম। কিস্তু সুন্দরী যুবতীদের দেখে তিনিও ঈমান আমান খুইয়ে বসেছেন!
অন্য ছ’টি মেয়ের কি অবস্থা করেছে কে জানে!’
‘অন্য সেনাপতি এবং কমাণ্ডাররা এদের শেষ করে দিয়েছে।’ মুবি বলল, ‘এদেরকে সন্ধ্যার সময় নিয়ে গেছে, দিয়ে গেছে খানিক আগে। এখন ওরা তাঁবুতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।’
কমাণ্ডার তরবারী কোষবদ্ধ করে তাঁবুতে প্রবেশ করল। কফি তৈরী করতে লাগল এক ব্যবসায়ী। কমাণ্ডারের অলক্ষ্যে কি যেন মেশাল তাতে। অন্য একজন জানতে চাইল তার পদমর্যাদা।
আলাপচারিতায় ব্যবসায়ীরা বুঝল লোকটা সেনাবাহিনীর উঁচু পর্যায়ের কেউ নয়, একজন সাধারণ গ্রুপ লিডার মাত্র। তবে লোকটা মেধাবী এবং সাহসী।
ওরা মেয়েদের ব্যাপারে সুলতানকে বলা গল্পটাই কমাণ্ডারকে পুনরায় শোনাল। জানাল এদের ব্যাপারে সুলতানের সিদ্ধান্ত। যোগ্য বর পেলে এরা মুসলামন হবে, দেশে ফিরবে না কখনো, তাও কমাণ্ডারকে বলা হল।
অন্য একজন বলল, ‘এ মেয়েটার সাথে তোমাদের প্রিয় সুলতান কি কাণ্ড ঘটিয়েছে তাতো ওর মুখেই শুনলে।’
কমাণ্ডার মেয়েটার দিকে তাকাল।
মুবি বলতে লাগল, ‘একজন দেবদুতের আশ্রয় পেয়েছি মনে করে আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না। সুর্য ডোবার সাথে সাথে সুলতানের নাম করে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। অন্যদের তুলনায় আমি একটু বেশী সুন্দরী। বুঝতে পারিনি তোমাদের আইয়ুবী আমাকে খারাপ উদ্দেশ্যে ডাকছে। আমি গেলাম। সুলতান মদের সোরাহী খুলে বসল। গ্লাস ভরে রাখল আমার সামনে। আমি খৃস্টান, মদপানে অভ্যস্ত।
আইয়ুবী আমাকে ভোগ করতে চাইল। পুরুষ নতুন নয় আমার জন্য। আমি যাকে দেবদূত মনে করি এ অপবিত্র দেহ থেকে তাকে দূরে রাখতে চাইলাম। কিন্তু সে জাহাজের খৃস্টানদের চাইতেও নিকৃষ্ট। দেহের প্রতিটি জোড়া ব্যথা করছে। হাড়গুলো মনে হয় ভেংগেই ফেলেছে।’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সে।’
একটু পর আবার শুরু করল, ‘ঈশ্বর আমায় রক্ষা করেছেন। নিষ্কৃতি দিয়েছেন দেবদুতরূপী পশুর হাত থেকে। সুলতান আমাকে বলেছে, অন্যান্য কমাণ্ডাররা বাকী মেয়েদের নিয়ে আনন্দ করছে। আমি সুলতানের পা ধরে মিনতি করলাম বিয়ে করার জন্য। সুলতান বলল, ‘বিয়ে ছাড়াই তুমি আমার হারেমে থাকবে।’