‘আমি সব জানি রবিন। আবেগের কথা নয়, এখন কাজের কথা বল। আমাদের এখন কি করতে হবে, কোন পথে এগুবো আমরা তাই বল শুনি।’
পরাজয়ের গ্লানি রবিনের স্নায়ূগুলো বিকল করে দিয়েছিল। মুবির মত সুন্দরী যুবতী তার বুকের সাথে লেপ্টে আছে। তার রেশম কোমল চুল রবিনের গালের অর্ধেকটা ঢেকে রেখেছে। কিন্তু তার অনুভূতি যেন ভোতা হয়ে গেছে।
মুবির চুলে বিলি কেটে রবিন বলল, ‘তোমার এ মায়াময় চুলের শৃংখলে আইয়ুীকে বাঁধতে পার না! মুবি, আমি জানি তুমি একটু চেষ্টা করলেই তোমার ধ্যানভাংগা রূপ আইয়ুবীকে তোমার দাসে পরিণত করবে। তোমার প্রথম কাজ হল, ক্রিস্টোফারকে বলবে ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশেই সে যেন নাজির কাছে পৌঁছে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে। নাজি যদি আইয়ুবীর সাথে মিশে গিয়ে থাকে, আমাদের যুদ্ধের পলিসি পাল্টাতে হবে। আমি বুঝতে পারছি, সংখ্যায় কম হলেও মুসলমানদের সহজে পরাজিত করা যাবে না। আগে ওদের জোশ ও ইসলামী জযবা ধ্বংস করতে হবে। বিজয়ের জন্য এটাই প্রথম শর্ত। আর এ জন্যই আমরা তোমাদের মত রূপসী তরুণীদের দিয়ে আরবের হারেমগুলো ভরিয়ে রেখেছি। তোমরা এতে সফল না হলে আমাদের সাফল্যের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।’
‘আবার কথা বাড়াচ্ছো? আমরা নিজের ঘরে নয়, শত্রুর তাঁবুতে বসে কথা বলছি। চারপাশে কড়া প্রহরা। ওদিকে রাতও শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মিশন ধ্বংস হয়ে গেছে। এ পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করতে হবে। এ জন্য এখান থেকেই শুরু করতে হবে কাজ।’
‘হ্যাঁ, সে কাজের কথাই বলছি, সবার আগে আমাদের দরকার নাজির খবর।’
‘সংবাদ সংগ্রহ করে তোমাকে কোথায় পাব?’
‘আমি এখান থেকে পালিয়ে যাব। তাঁর আগে আইয়ুবীর ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও তার সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেব।’
‘আমারও মনে হয় সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একটা লোকই ক্রুশের জন্য বিপজ্জনক।’
‘তাই, আর এ জন্যই আইয়ুবীকে হত্যা করা জরুরী। আর ও বেঁচে থাকলে থাকবে আমাদের বন্দীশালায়।’
‘কিন্তু কিভাবে?’
‘শোন, প্রথমেই তাঁবুতে গিয়ে ওদের বলবে, যে করেই হোক আলী বিন সুফিয়ানকে ফাঁসাতে হবে। আলী এবং আইয়ুবীর মাঝে তুলে দিতে হবে ঘৃণার দেয়াল। এরপর যাবে ক্রিস্টোফারের কাছে। বলবে, লক্ষ্য ভেদ না করে যে পাপ করেছ, দায়িত্ব পালন করে এবার তা মোচন করার চেষ্টা কর।’
‘ঠিক আছে রবিন। দোয়া করো যিশু যেন আমার সহায় হন।’
রবিন মুবির চুলে চুমো খেয়ে বলল, ‘ক্রুশের জন্য তোমাকে তোমার ইজ্জত বিলিয়ে দিতে হবে। তবে মনে রেখ, যিশুর কাছে তুমি থাকবে মা মেরীর মতই পবিত্র কুমারী। ইসলামের মূল উপড়ে ফেলে আমরা জেরুজালেম দখল করেছি, এবার মিসরও আমাদের হবে।’
রবিনের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল মুবি। তাঁবুর পর্দা ঈষৎ ফাঁক করে তাকাল বাইরে। কোথাও কেউ নেই।
নিঃশব্দে বেরিয়ে এল মুবি। তাঁবুর সাথে সেঁটে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি বুলাল চারদিকে। দূর থেকে কারো গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে। সম্ভবতঃ প্রহরী।
হাঁটা দিল মুবি। গাছের আড়ালে আড়ালে গা বাঁচিয়ে পৌঁছল টিলার কাছে। টিলা পার হয়ে চলতে লাগল নিজের তাঁবুর দিকে। তাঁবুর কাছাকাছি চলে এসেছে মুবি, দু’জন লোকের অনুচ্চ কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এল। থমকে দাঁড়াল মুবি, উৎকর্ণ হয়ে তাকাল সামনে। শব্দ আসছে তাঁবুর দিক থেকে।
ও তাঁবুতে নেই হয়ত ওরা জেনে গেছে, এ জন্য ডেকে এনেছে কমাণ্ডার বা অন্য কাউকে। ধরা পড়লে চলবে না।
ব্যাবসায়ীদের সংগীদের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ও। এতে অন্য মেয়েগুলো বিপদে পড়তে পারে ভেবে দাঁড়াল আবার।
কয়েক পা এগিয়ে গেল লোক দুটোর কথা শোনার জন্য। কিন্তু ও কাছে পৌঁছার আগেই কথা থামিয়ে দিয়েছে ওরা। এখন কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
একপা দু’পা করে হাঁটছে ও, হঠাৎ বায়ে শব্দ হল। চমকে সেদিকে তাকাল মুবি। গাছের একটা ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
ও টিলার কাছে ফিরে এল। উঠে দাঁড়াল টিলার ওপর। সাগর পাড়ের জোৎস্না ধোয়া রাত। এখন ওকে দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে।
ডিউটি পরিবর্তনের সময় হয়ে এসেছে। প্রহরীদের অবস্থা দেখার জন্য বেরিয়ে গেলেন কমাণ্ডার। টিলার ওপর একটা ছায়া দেখতে পেলেন। দাঁড়িয়ে পড়লেন কমাণ্ডার।
ছায়াটা তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। দু’হাত সামনে আসা চুল ঠিক করল। দেহের গঠনে মেয়ে মনে হচ্ছে। কমাণ্ডার অপেক্ষা করছেন।
জ্বীন ভূত হলে অদুশ্য হয়ে যাবে, কিন্তু ছায়াটা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগর। কমাণ্ডার বুঝে ফেললেন, এ জ্বীন নয়, মানুষ। সুলতান আইয়ুবীর সতর্কবাণী তার মনে পড়ল। তাদের বলা হয়েছে খৃস্টানরা গুপ্তচর হিসেবে মেয়েদের ব্যবহার করছে। কখনও বেদুঈন আবার কখনও ভিক্ষুক সেজে ওরা আসবে। নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আশ্রয় চাইবে। আরও তাকে বলা হয়েছে, সুলতান সন্দেহভাজন সাতজন মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছেন। অপেক্ষা করছেন গোয়েন্দা প্রধান আলীর জন্য। তিনি এলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে।
প্রহরীদের ডিউটি পরিবর্তনের সময় কমাণ্ডার ফখরুল মিসরি তাঁবুর পর্দা তুলে দেখলেন সাতটা মেয়েই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কম্বল সরালে দেখা যেত সপ্তম মেয়েটা বিছানায় নেই। টিলার ওপরই যে ওই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে কমাণ্ডার তা বুঝতে পারেনি।